করোনাকালে অফিসে বা ব্যবসা-বাণিজ্যে আপনার কি প্রমোশন বা পদোন্নতি হয়েছে? যদি হয়ে থাকে, তবে দয়া করে আপনার অধীনস্থ মাস্কের প্রতি দৃষ্টি দিন। তাকেও প্রমোশন দিন, তাকে থুতনি থেকে নাকে-মুখে ওঠার সুযোগ দিন। আর যদি প্রমোশন না পেয়ে থাকেন, তবে ভবিষ্যতে যাতে পেতে পারেন এবং আমাদের সেই আনন্দে মিষ্টি খাওয়াতে পারেন, সে জন্য অন্তত মাস্কের প্রমোশন দিন! কারণ, বেঁচে থাকলেই তো পদোন্নতি পাবেন, তাই না?
এ দেশে মাস্কের প্রথম দফা প্রমোশন হয়েছিল গত বছরের মার্চ-এপ্রিলের দিকে। শুরুতে কিছুদিন ভালোই ছিল মাস্কের অবস্থা। অবশ্যই অধিকাংশ মানুষ তখনো মাস্ককে চাকরি দিতে রাজি ছিলেন না। তবে মাস্কের জীবনবৃত্তান্ত দেখে এবং আগের কর্মস্থলে তার কর্মনৈপুণ্য জেনে, এ দেশের বেশ কিছু মানুষ মাস্ককে চাকরি দিয়েছিলেন। সে ক্ষেত্রে অনিচ্ছার চেয়ে প্রয়োজনটাই বেশি ছিল। অথচ কয়েক মাস পরই মাস্ককে আমরা ডিমোশন বা পদাবনতি দিয়ে দিলাম। যদিও কোনোভাবেই বলা যাবে না যে মাস্কের পারফরম্যান্স খারাপ ছিল।
পাঠক, মাস্কের কর্মনৈপুণ্য যে খারাপ ছিল না, তা প্রমাণের জন্য কিন্তু আপনার চোখজোড়াই যথেষ্ট। এই লেখাটা যে পড়ছেন, চোখজোড়া খোলা না থাকলে কি তা সম্ভব হতো? আর নাকে-মুখে মাস্ক না থাকলে কি চোখ খোলা থাকত? চোখ খোলা না থাকলে কি মোবাইলে বা ডেস্কটপে স্ক্রল করতে পারতেন?
আফসোসের কথা, আমরা বড়ই অকৃতজ্ঞ। স্রেফ করোনার প্রকোপ কমায় আমরা সেই পরম বন্ধু মাস্ককে ভুলে গেলাম। সেই বাংলা বাগ্ধারাটির কথা মনে পড়ে—‘কাজের বেলায় কাজী, কাজ ফুরালে পাজি’। আমাদের কাজ ফুরায়নি অবশ্য। তার পরও আমরা মাস্কের দোষ-ত্রুটি খুঁজতে ব্যাকুল হয়ে গেলাম। বলতে থাকলাম, ‘মাস্ক থাকলে ঠিকমতো শ্বাস নেওয়া যায় না’, ‘এতক্ষণ মুখে মাস্ক রাখা যায়?’, ‘আরে, করোনা নাই!’, ‘কান ব্যথা করে’, ‘মাস্কের কারণে কান বেঁকে যাইতেছে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এভাবেই নাক থেকে, মুখ থেকে মাস্ক নেমে গেল থুতনিতে। অনেকে অবশ্য একেবারেই বিদায় জানিয়ে দিলেন উপকারী কর্মীটিকে। সেই থেকে চাকরি হারানো কর্মহীন মাস্কগুলোর বাক্স থেকে বাইরে বের হওয়া কমে গেল। আর এত কিছুর পরও মাস্কদের নিয়ে যাঁরা বাইরে বেরোতেন, তাঁদের অনেকেই মাস্কের কর্মস্থল বদলে দিলেন। পদায়ন হলো থুতনিতে। যদিও নাকের ফুটো থুতনিতে স্থানান্তরিত হয়েছে বলে কোনো গবেষণায় জানা যায়নি!
আর যাঁরা এত কিছুর পরও মাস্ক নাকে-মুখে রাখতেন অর্থাৎ মাস্কের চাকরিটা খাননি আরকি, সেই সদয় চাকরিদাতাদের যে কী বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হতো! ভাবুন একবার, চারপাশে সবাই স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে খালি মুখে যা খুশি করে যাচ্ছে, অথচ কেউ কেউ মাস্কের চাকরি খায়নি বলে তাদের দিকে সবাই কিম্ভূত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে! সত্যি বলছি, আমি নিজেও এমন পরিস্থিতিতে বেশ কয়েকবার পড়েছি। মনে হতো, যেন অন্য কোনো ছায়াপথের অন্য কোনো গ্রহ থেকে থানোসের মতো হুট করে চলে এসেছি! কেউ কেউ হাসি দিত, টিপ্পনীও কাটত কি না কে জানে।
তবে একটি বিষয় মাথায় রাখবেন। কেউ সারাটা জীবন পড়ে পড়ে মার খেয়ে যেতে পারে না। বাংলা সিনেমার মতোই একদিন নায়কের মটকা গরম হয়ে যায়। তখন আর তার ‘বড়লোক’ হওয়া ঠেকাতে পারেন না কোনো ‘চৌধুরী সাহেব’। মাস্কও এবার ফর্মে ফেরার পথে রয়েছে। এবার কিন্তু আমাদের ভুল শুধরে নেওয়ার পালা।
আচ্ছা, আমরা কি এবার চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মাস্ককে প্রমোশন দিয়ে দিতে পারি না? একবার যেহেতু চাকরি খেয়েছেন, সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করলে মন্দ হয় না। দয়া করে, নিজের দিক থেকে ভাবুন। আপনি কি পদোন্নতি পেলে খুশি হন না? উৎসাহিত বোধ করেন না? তবে যখন চাকরিদাতা হলেন, তখন কেন মাস্কের প্রতি একই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করছেন না?
সুতরাং, সাম্যের পথে হাঁটুন। মাস্ককে পদোন্নতি দিন। মনে রাখবেন, অন্যকে প্রাপ্য ‘সম্মান’ (এখানে অর্থ, মাস্কের প্রমোশন) দিলেই নিজের ‘সম্মান’ (অর্থাৎ নিজের জান বা প্রাণ) মেলে।
অতএব, সময় থাকতে লাইনে চলে আসুন। থুতনিতে যে কোনো ফুটো নেই, সেটি বোঝার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে পারেন। তাতেও বুঝতে সমস্যা হলে দয়া করে নিজের থুতনি নিজেই পরীক্ষা করুন। গবেষণার এ পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, পরিশ্রম আছে। আবার আছে অপার সম্ভাবনাও। যদি থুতনিতে ফুটো খুঁজে পেয়েই যান, তবে কিন্তু দারুণ কাজ হবে। অন্তত প্রাণীদের নতুন প্রজাতি আবিষ্কারে এ দেশের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে যাবে। এমনকি আবিষ্কারক হিসেবে অস্কারও পেয়ে যেতে পারেন!
কী করবেন, এবার নাহয় তা ঠিক করেই ফেলুন। জানেন তো, সময় গেলে সাধন হবে না।