মা দিবস
মা আমার গান ভালোবাসতেন
কাল ৯ মে রোববার, মা দিবস। মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাতে বিভিন্ন দেশে মে মাসের দ্বিতীয় রোববার দিনটি পালিত হয়। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের দুঃসময়ে এল দিনটি। করোনায় যাঁরা মাকে হারিয়েছেন, এমন তিনজন তাঁদের মায়ের কথা স্মরণ করেছেন। এখানে প্রয়াত সংগীতশিল্পী মিতা হককে নিয়ে লিখেছেন তাঁর মেয়ে ফারহিন খান জয়িতা
জীবদ্দশায় সংগীতশিল্পী মিতা হক শুধু আমার মা নন, আরও অনেক মানুষের মা ছিলেন। ভালোবাসা, মমতা, প্রশ্রয়ে কত মানুষকে যে তিনি কাছে টেনে নিয়েছিলেন, সেই হিসাব কখনো করা যাবে না। আর তাঁর একমাত্র মেয়ে হওয়ায় আমি অন্য রকম এক ভালোবাসায় জড়িয়ে ছিলাম। তাঁর সব মনোযোগ, অগ্রাধিকার ছিল আমাকে ঘিরে। মায়েরা তো এমনই হয়।
মা অসম্ভব ব্যস্ত জীবন কাটিয়েছেন। তবু আমার স্কুলের টিফিন বানিয়ে দিতে ভুল হয়নি, আমাকে আনা-নেওয়াও ছিল তাঁর এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মায়ের একটা বিশেষ রূপ প্রায়ই মনে পড়ে। স্কুল ছুটির সময় আমরা লাইন ধরে বেরোতাম। কিন্তু আমি ভিড়ের মধ্যে যাওয়া পছন্দ করতাম না বলে একদম শেষে বেরোতাম। কিন্তু মা আমাকে নিতে চলে আসতেন সবার আগে, আর স্কুলের গেটের সামনে একটা আতঙ্কিত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন, আমার দেরি দেখলে আয়াতুল কুরসি পড়তেন বিড়বিড় করে। তাঁর কিসের এত ভয়, আমার জানা হয়নি। প্রতিদিন দেরি করার জন্য আমি বকা খেতাম আর হেসে কুটিকুটি হতাম। এটা আমার জন্য যেন একটা ‘খেলা’ হয়ে গিয়েছিল।
আমি, মা আর বাবা (অভিনেতা খালেদ খান), আমরা তিনজন তিনজনকে গভীরভাবে আগলে রেখেছি সারা জীবন। বাবা চলে যাওয়ার পর মা আর আমি পরস্পরকে আরও গভীরভাবে আঁকড়ে ধরে ছিলাম। মা ভাবতেন, আমি যেন বাবার অভাব প্রকটভাবে অনুভব না করি। আমিও ভাবতাম, মা যেন বাবার জন্য কষ্ট না পায়। এমনই হয় বোধ হয়।
আমি গান করি। মা আমার গান ভালোবাসতেন। কিন্তু হঠাৎ যখন দুখানা আবৃত্তি রেকর্ড করে বসলাম, এত খুশি হলেন, আর কতবার যে বললেন, ‘তোমার বাবাকে খুঁজে পেলাম।’ একটা কবিতা কতবার যে ফেসবুকে শেয়ার করলেন। জানি না আবৃত্তির কিছু হয়েছেন কি না, তবে তাঁর উত্তেজনা দেখে আমার হঠাৎ মনে হলো, আমরা দুজনই মনে হয় বাবাকে কোথাও না কোথাও খুঁজে চলেছি সবকিছুর মধ্যেই।
মায়ের জীবনে দুটো চাওয়া—আমার সুস্থতা আর গান। এমন এক দিনও ছিল না, যেদিন মা এসব নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করেননি। মায়ের কাছ থেকে যে কতবার শুনেছি, আমি অলস, আমি উদাসীন। আমি নাকি আমার কোনো কিছুর ব্যাপারেই যত্নশীল নই।
গান আমি মনের সুখে গাই, আমার এসব নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করতে ভালো লাগে না। কেউ ডাকলে, গাইতে ইচ্ছে করলে গাই। কিন্তু গাওয়ার জন্য নিজে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া আমার ধাতে নেই। এই যে উদ্যোগী না হওয়া এবং গান কম গাওয়া নিয়ে মায়ের ছিল অনেক দুঃখ। তাই দুজনের প্রতিদিনই এসব নিয়ে একটা বেশ জটিল আলাপ চলত। কখনো রেগে যেতাম, কখনো তাঁর কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে যেতাম। কিন্তু মা ক্লান্ত হতেন না, বলেই যেতেন।
মা অনেক অনুরোধ করেছেন সব সময়ই, মাসে যেন অন্তত একটা গান রেকর্ড করি। শুধু বলেছিলেন, ‘এখনকার মতো গাওয়ার ক্ষমতা পরে না–ও থাকতে পারে। নতুন নতুন গান তোলো, রেকর্ড কোরো।’
আমার মা আর নেই, আমার চোখের সামনে নেই। কিন্তু মা আমার জীবনজুড়ে আছেন। যতবার শ্বাস নেব, ততবার মাকে মনে পড়বে। মাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমার কিছু করতে হবে না। যত ভালোবাসা, যত সম্মান এই মানুষ অর্জন করেছেন এক জীবনে, তাঁর জন্য আমার কিছু না করলেও কিছু যায় আসে না।
বাংলাদেশ যত দিন আছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টির চর্চা যত দিন আছে, বাঙালির সংস্কৃতির শুদ্ধচর্চা যত দিন আছে, মিতা হকও তত দিন থাকবে। তাঁর গান, তাঁর কণ্ঠ, তাঁর উচ্চারণ, তাঁর জীবনাদর্শ, তাঁর রাজনৈতিক দর্শন, আদর্শের ব্যাপারে তাঁর বলিষ্ঠ এবং স্পষ্ট অবস্থান তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে। বাংলাদেশ বলে একটি রাষ্ট্র যত দিন আছে, সেটা পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত থাকলে তত দিনই। আমি এটা বিশ্বাস করি। আমি শুধু তাঁর কথা রাখতে চেষ্টা করব। গান নিয়ে যেভাবে তিনি আমার এগিয়ে যাওয়া দেখতে চেয়েছিলেন, সেই চেষ্টা আমি করব। মা সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক আদর্শের জন্য তাঁর জায়গা থেকে যেভাবে লড়ে গেছেন, সেই আদর্শ আমি নিজের মধ্যে লালন করে যাব, যত দিন বেঁচে থাকব। সেই কথা আমি নিজেকে দিয়েছি।
তবে শুধু থেকে থেকে মনে হয়, স্কুল গেট থেকে আমার বেরোতে দেরি হলে যাঁর ভয়ে প্রাণ উড়ে যেত, এত বড় পৃথিবীতে আমাকে এভাবে একদম একা ফেলে যাওয়ার সময় মা কি কিছু ভাবছিলেন? ভাবছিলেন, জয়িতা ভয় পাবে না তো? আমার মেয়েটা একা পারবে তো?
লেখক: প্রয়াত সংগীতশিল্পী মিতা হক ও অভিনেতা খালেদ খানের মেয়ে