যারা ভোট দেবে, তারা কি রাশিয়ায় যেতে পারবে?

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা
ফাইল ছবি

একজন আরেকজনকে দেখে শেখে। ভালোটাও শিখতে পারে, আবার মন্দটাও। কে কোনটা শিখবে সেটা শিখতে ইচ্ছুক ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে। সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা গেল, নির্বাচন দেখতে রাশিয়ায় যাচ্ছে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের একটি প্রতিনিধিদল। অর্থাৎ যাঁরা ভোট নেন বা ভোটের আয়োজন করেন, তাঁরা কিছু দেখার জন্য এবং দেখা থেকে শেখার জন্য রাশিয়ায় যাচ্ছেন। প্রশ্ন হলো, যাঁরা ভোট দেবেন, তাঁরা কি রাশিয়ায় যেতে পারবেন?

সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত খবর অনুযায়ী, রাশিয়ার পার্লামেন্ট নির্বাচন পর্যবেক্ষণে সে দেশ সফরে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের প্রতিনিধিদল। সিইসির নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদলটির এই সরকারি সফরের বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) কার্যালয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। ইসির উপসচিব শাহ আলম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, সিইসি কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধিদল রাশিয়ার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ‘স্টেট দুমা’ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে সরকারি সফরে যাবে। আগামী ১৭–১৯ সেপ্টেম্বর দুমার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। রাশিয়ার নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে দুমার নির্বাচন পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলটি যাচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

রাশিয়ায় নির্বাচন দেখতে যাওয়া নিয়ে একটি সরকারি সফর হচ্ছে। এটা ভালো খবর। জানাশোনা বাড়ানো তো দরকার। কিন্তু কেন রাশিয়ায় যাওয়া হচ্ছে, তার কারণ যেহেতু সরকারিভাবে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা হয়নি, তাই নিজেই একটু রাশিয়া বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলাম। আল–জাজিরার এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়ায় স্টেট দুমা নির্বাচন হলো মূলত পার্লামেন্ট নির্বাচন। সেখানে নির্বাচন নাকি খুব একটা স্বাধীন ও সুষ্ঠু হয় না। এবারের নির্বাচন নিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আজীবনের জন্য রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দল ইউনাইটেড রাশিয়া নাকি একটু বেকায়দায় আছে, জনসমর্থন কমছে। এবারের নির্বাচনের মাধ্যমে মূলত জনগণের সমর্থন যে ইউনাইটেড রাশিয়ার আছে, সেটিই প্রমাণ করার চেষ্টা করবে ক্ষমতাসীনেরা।

২০১৮ সালে রাশিয়ার মস্কো শহরে নির্বাচনী প্রচারণায় ভ্লাদিমির পুতিন
ছবি: রয়টার্স

বিখ্যাত সাময়িকী ফরেন পলিসি চলতি মাসে রাশিয়ার নির্বাচন নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, রুশ সরকারের নাকি জনপ্রিয়তা প্রমাণের তাগিদ আছে। অর্থাৎ জনগণের যে এই সরকারের প্রতি আস্থা আছে, সেটি প্রমাণ করার একটি অ্যাজেন্ডা আছে। আর তার জন্যই উপযুক্ত মঞ্চ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে এবারের নির্বাচনকে। আর বিরোধী দলের অবস্থা রাশিয়ায় খুব একটা ভালো নয়। অ্যালেক্সি নাভালনিকে পাঠানো হয়েছে জেলে। তাঁর দলসহ অন্যান্য বিরোধীরাও ব্যাপক দমন–পীড়নের শিকার বলে ফরেন পলিসি দাবি করেছে।

এসব দেখার পর মনে হলো, কেন আমরা রাশিয়ায় নির্বাচন পর্যবেক্ষণে যাচ্ছি? মানে, আমরা আসলে কী শিখতে যাচ্ছি? শেখার তালিকায় কী কী আছে? ও হ্যাঁ, আরও একটা জিনিস খুঁজে পাইনি। রাশিয়ায় নির্বাচনটি বাংলাদেশ সময় রাতে নাকি দিনে হবে, সেটি ঠিক ঠাওর করতে পারিনি। অন্তর্জালের দুনিয়া বিষয়টা স্পষ্ট করে জানাচ্ছে না। আবার আমার খোঁজার ভুল হতে পারে। মানুষ মাত্রই তো ‘ভুলনশীল’!

তবে রাশিয়ায় কর্তারা যখন যাচ্ছেন, জেনে–বুঝেই যাচ্ছেন বলে আমার বিশ্বাস। এই কঠিন–জটিল দুনিয়ায় না বুঝে কেউ পানিও খায় না। সুতরাং না বুঝে রুশ দেশে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে যা–ই শেখা হোক, তা হবে ভোট নেওয়া কর্তৃপক্ষের। আমরা যারা ‘সুষ্ঠুভাবে’ ভোট দেওয়ার জন্য চাতক পাখির মতো বসে থাকি, তাদের কি কিছু শেখার দরকার নেই? তাদের কি রাশিয়ায় পর্যবেক্ষণ চালানোর ইচ্ছা হতে পারে না? এভাবে আমরাও তো কিছু শিখে–পড়ে আসতে পারি। তাতে হয়তো আমাদের ভোট দেওয়াতেও ‘উচ্চমানসম্পন্ন’ প্রভাব পড়তে পারে। সেই ফাঁকে একটু বিদেশ ঘোরাও হলো গরিব এই ভোটদাতাদের।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এভাবে নির্দিষ্ট বিদেশ সফরের মাধ্যমে ভোটদাতাদের যদি সবকিছু (মানে কর্তাদের যা ‘কাঙ্ক্ষিত’ আরকি!) আগেভাগে শিখিয়ে–পড়িয়ে দেওয়া যায় এবং বুঝিয়ে দেওয়া যায়, ‘কী করিলে কী হয়’—তবে কিন্তু আর চিন্তা নেই। সব হবে চাহিদামাফিক, ‘ফর্মুলা’ মোতাবেক!

গত বছর জেনেছিলাম, যুক্তরাষ্ট্র চার থেকে পাঁচ দিনে ভোট গুনতে পারে না। আমরা নাকি চার থেকে পাঁচ মিনিটে গুনে ফেলি। এবার রাশিয়া সফরের পর আমাদের সক্ষমতা কোন পর্যায়ে পৌঁছে যায়, কে জানে! হয়তো এমন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হবে যে ভোট দিতে শরীরটা নিয়ে বের হতেই হবে না। শুধু মনে মনে ভাবব, ওকে দেব! তাতেই টেলিপ্যাথিক সিল পড়বে ব্যালটে।

আহা, এমন উন্নতিই তো আমরা চাই। ভাবতে ভালোই লাগে। শুধু বিদেশ সফরটা একটু নিশ্চিত হলেই হয়!