বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হবে আর কদিন পর। সেবার এলাকার বড় ভাইয়েরা সিদ্ধান্ত নিলেন, এলাকায় আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল দুই দলেরই বিশাল দুটি পতাকা তোলা হবে। পতাকার নিচে সমর্থকদের নাম থাকবে।
একদিন সকালে দেখি, গলির মোড়ে বসে একটা খাতায় কে কোন দলের সমর্থক তার তালিকা করা হচ্ছে। এলাকায় আমার খুব ঘনিষ্ঠ বড় ভাই ছিলেন আমিরুল ভাই। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জটিলতায় আমিরুল ভাই-ই ছিলেন আমার একমাত্র ভরসা। তবে আমিরুল ভাই যে খুব পরোপকারী লোক তা কিন্তু নয়। আমিরুল ভাইয়ের উপকারের বিনিময়ে সপ্তাহে দুবার তাঁর প্রেমপত্র নিয়ে ময়না আপুকে দিয়ে আসতে হতো, তা-ও রিটার্ন চিঠি নিয়ে। সেই আমিরুল ভাই আমার নামটি দিয়ে দিলেন ব্রাজিল সমর্থকের তালিকায়। কেননা, তিনি ছিলেন কট্টরপন্থী ব্রাজিল–সমর্থক।
ফুটবল খেলা নিয়ে আমার অতটা আগ্রহ ছিল না। তারপরও আমিরুল ভাই যখন ব্রাজিলের দলে আমার নামটা দিয়ে দিয়েছেন, তাই আর কোনো গাঁইগুঁই করলাম না। ব্রাজিল–সমর্থক হলেই বা খারাপ কী, পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, চাট্টিখানি কথা নাকি! ভাবলাম, আমাদের বাসার ছাদেও একটা পতাকা লাগাব।
আমিরুল ভাইকে দিয়ে বাবাকে বলিয়ে পতাকার কাপড় কেনার টাকাও জোগাড় হলো। সবই ঠিকঠাক ছিল কিন্তু ঝামেলা বাধল অন্য জায়গায়। আমরা যে বাসায় ভাড়া থাকতাম, সেই বাসার মালিক ছিলেন বড়ই বজ্জাত। তাঁরা থাকতেন তিনতলায় আর আমরা দোতলায়। বাড়িওয়ালার একটা মেয়ে ছিল। বাড়িওয়ালা দুষ্টু, কিন্তু তাঁর মেয়েটা ছিল মিষ্টি। তার নামও ছিল মিষ্টি।
প্রথম যেবার এই বাসায় উঠি, তখনই তাকে দেখে আমি খেলার মাঠে উল্টে যাওয়া নেইমারের মতো কাত! নিজের নামটা যখন ব্রাজিলের খাতায় দিয়েই দিলাম, তখন মিষ্টি কোন দলের সমর্থক, সেটাও জানা উচিত। তাই একদিন মিষ্টির ছোট ভাইকে ডেকে বললাম, ‘কী, কোন দল সাপোর্ট করো?’
বলল, ‘কেন, আর্জেন্টিনা।’
আমি বললাম, ‘তুমি যে আর্জেন্টিনা করো, তা বাসার সবাই কী করে?’
মিষ্টির ছোট ভাই যা বলল, তাতে রীতিমতো ঝামেলায় পড়ে গেলাম। বাসার সবাই নাকি আর্জেন্টিনা সাপোর্ট করে। সুতরাং মিষ্টিও আর্জেন্টিনা। ফুটবল সম্পর্কে তেমন একটা না জানলেও এতটুকু জানি যে, আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল—এই দুই দলের সমর্থকদের সম্পর্ক সাপে-নেউলে। কী করি, কী করি ভাবতে ভাবতে আমার তিন রাত ঘুম হলো না।
তারপর একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম। আর্জেন্টিনার বিশাল এক পতাকা ছাদে লাগিয়ে দিলাম। পুরো এলাকাজুড়ে জানিয়ে দিলাম, আজ থেকে আমি আর্জেন্টিনার ‘ডাই হার্ট’ ফ্যান। ব্রাজিল–সমর্থকদের সঙ্গে তর্ক করতে শুরু করলাম ধুমসে। মেসি যে পৃথিবীর উদীয়মান সেরা খেলোয়াড়, তা বোঝানোর জন্য গলার স্বর যতটা উঁচু করার প্রয়োজন ছিল তার থেকে বেশি উঁচু করলাম, কিনে ফেললাম জার্সি।
এদিকে আমিরুল ভাইকে দেখলেই অন্য গলি দিয়ে পালিয়ে যাই। কিন্তু হঠাৎ একদিন ছাদে উঠে দেখি, একই বাঁশের আগায় আমার পতাকার ওপর ব্রাজিলের একটা পতাকা উড়ছে! নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। দিলাম এক বিশাল হুংকার। চিৎকারের আওয়াজে তিনতলা থেকে মিষ্টি এসে বলল, ‘কী হয়েছে, এত চিল্লাচ্ছেন কেন?’
মিষ্টিকে দেখে গলার স্বর নিচে নামিয়ে খুবই করুণ সুরে বললাম, ‘এই বাঁশের মাথায় ব্রাজিলের পতাকা কে লাগিয়েছে, বলতে পারেন?’
উত্তরে যা শুনলাম তার জন্য সত্যিই প্রস্তুত ছিলাম না! মিষ্টি বলল, ‘আমি লাগিয়েছি। কেন, কোনো সমস্যা? আমি আর্জেন্টিনা–সমর্থক একেবারে দেখতে পারি না। হাত দিয়ে গোল দেয় আবার বড় বড় কথাও বলে। পতাকা যে খুলে ফেলে দিইনি, সেটাই অনেক।’
কথা বলতে বলতে মিষ্টি আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন আমি আর্জেন্টিনা–সমর্থক নই, আমি একজন দাগি আসামি। আমার মাথায় তখন আকাশ ভেঙে পড়ল। বাকিটা জানার প্রয়োজন বোধ করলাম না। মাথা নিচু করে রুমে চলে এলাম।
পরে জানতে পারলাম, মিষ্টির ছোট ভাই আসলে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের পার্থক্য বোঝে না। ওর কাছে আর্জেন্টিনা যা, ব্রাজিলও তা। সেদিন আসলে ও না বুঝেই আর্জেন্টিনার কথা বলেছিল।
তারপর থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম, জীবনে প্রথমবার যখন ছ্যাঁকা খেলামই তাহলে আর্জেন্টিনাই হোক আমার পছন্দের দল। আর এভাবেই আমি হয়ে গেলাম আর্জেন্টিনার সমর্থক।