যে কারণে তাঁর নাম হয়েছিল হই হই কাজী

আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। সারা জীবন তিনি সংগ্রাম করেছেন ভালোর পক্ষে। গেয়েছেন মানবতার জয়গান। জন্মেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ১৩০৬ সনে। ছেলেবেলায় লেটো দলের বাদক, রেল গার্ডের খানসামা, রুটির দোকানের শ্রমিক—নানা রকম পেশা বেছে নিয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন সৈনিক হিসেবে। সাংবাদিকতাও করেছেন। পথে নেমেছেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। আর লিখেছেন অসাধারণ সব কবিতা। বাংলা গানেও তাঁর তুলনা নেই। কবির ছেলেবেলা নিয়ে এই আয়োজন...

অলংকরণ: আরাফাত করিম

মায়ের নজর আলি

কাজী নজরুল ইসলামের ডাকনাম তো সবারই জানা—দুখু মিয়া। তাঁর কিন্তু আরও নাম ছিল! কবিকে কেউ ডাকত ‘নুরু’, কেউ ‘তারাখ্যাপা’, ‘খুদে’, ‘ওস্তাদ’, ‘ব্যাঙাচি’ নামে। মা জাহেদা খাতুন নজরুলকে ডাকতেন ‘নজর আলি’। কারও যাতে নজর না লাগে, হয়তো সে কারণেই। কবির নজর কিন্তু অন্য দিকে। পড়াশোনার চেয়ে বন্ধুরা মিলে কার বাগানে কোন লিচুতে রং ধরেছে, কোন গাছের পেয়ারা ডাঁসা হয়েছে—এসব দিকেই বেশি মনোযোগ। সবাই ধরেই নিল এই বাউণ্ডুলেকে দিয়ে আর যা–ই হোক পড়াশোনা হবে না। কিন্তু একবার হলো কি, বার্ষিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর দেখা গেল, নজরুল খুব ভালো করেছেন। এতটাই ভালো যে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ডবল প্রমোশন দিয়ে দিল। সঙ্গে রাজবাড়ি থেকে মাসে সাত টাকা বৃত্তি।

ভূতগাছ থেকে নিমপাতা

কবির সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। দুই বন্ধু যেন হরিহর আত্মা। একদিন বিকেলে দুজন ঘুরতে বেরিয়েছেন। ফেরার সময় উঠল ঝড়। দুজন দিলেন দৌড়। হঠাৎ পড়ে গিয়ে শৈলজানন্দের হাঁটুর কাছে অনেকটুকু কেটে গেল। নজরুল বন্ধুকে ধরে বাড়ি পৌঁছে দিলেন ঠিকই কিন্তু দুশ্চিন্তা কমল না। সেই রাতেই নিমপাতা নিয়ে বন্ধুর পড়ার ঘরের জানালায় উঁকি দিলেন।

নজরুলকে দেখে শৈলজানন্দ অবাক। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, এত রাতে সে নিমপাতা পেল কোথায়?

নজরুলকে জিজ্ঞেস করতেই একগাল হেসে বললেন, নিমগাছ খুঁজতেই তো রাত হয়ে গেল। খ্রিষ্টানদের কবরখানার নিমগাছে উঠে পাতা পেড়ে আনলাম।

এত রাতে গাছে উঠলে! শৈলজানন্দ চমকে উঠে বললেন, তুমি জানো না, ওই গাছে ভূত আছে?

নজরুল হো হো করে হেসে উঠে বললেন, ধুর! আমি ভূতের ভয় করি নাকি?

ইংরেজ খতম

আরেক দিন হলো কি, বন্ধু পাঁচু এয়ারগান কিনে এনেছে। নজরুল সেটি বগলদাবা করে চললেন খ্রিষ্টানদের কবরখানায়। পাখি বাদ দিয়ে এয়ারগান তাক করলেন সিমেন্টের বেদির দিকে। তারপর আক্রোশে গুলি ছুড়তে লাগলেন ঠুসঠাস।

নজরুলের কাণ্ড দেখে শৈলজানন্দ অবাক, এসব কী হচ্ছে?

নজরুল বললেন, ইংরেজগুলোকে খতম করছি।

ইংরেজদের ওপর নজরুলের ভীষণ রাগ। ওরা দেশের শত্রু। তাই কবরস্থানের সিমেন্টের বেদিগুলো একেকটি বড়লাট, ছোটলাট, ম্যাজিস্ট্রেট মনে করে নজরুল গুলি ছুড়তেন। কারণ ওই একটাই—যুদ্ধ করে হলেও ওদের তাড়িয়ে দেশ স্বাধীন করতে হবে।

দুখু কিংবা হই হই কাজী

সত্যি সত্যি নজরুল একদিন পালিয়ে যুদ্ধে চলে গেলেন। কবি তখন ৪৯ রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিক। সৈনিক হলে কী হবে, কবি ব্যারাকের সবাইকে প্রাণচাঞ্চল্যে মাতিয়ে রাখতেন। প্রায়ই সন্ধ্যায় বসাতেন গানের আসর। সহযোদ্ধাদের দু–একজন তাল মেলাতেন। ফলে গান জমে উঠত। শ্রোতারা তখন বাহবা দেওয়ার মতো উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠতেন। হাসি-গানে–ঠাট্টায় সবাইকে মাতিয়ে দিতে নজরুল ছিলেন একাই এক শ। ছেলেবেলা থেকেই গান ছিল তাঁর প্রাণ। মুখে মুখে সুন্দর গান বাঁধতে পারতেন। বাজাতে পারতেন বাঁশি। অল্প বয়সে গানের দলও গড়েছিলেন। সব সময় এভাবে হই হই করে পল্টন মাতিয়ে রাখতেন বলে কবির নামই হয়ে গিয়েছিল ‘হই হই কাজী’।

‘দুখু’ কিংবা ‘হই হই কাজী’—যা–ই বলি না কেন, কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের ভালোবাসার আরেক নাম। আমাদের অনুপ্রেরণা।