ভারতের মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভূপাল। বিন্ধ্য পর্বতের পাদদেশে এবং মালওয়া মালভূমির ওপর অবস্থিত ভূপালকে বলা হয় হ্রদের শহর। ১৯৮৪ সালের ২ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে ভূপালবাসীর জীবনে নেমে আসে বিভীষিকাময় অন্ধকার। ভূপালের জয়প্রকাশ অঞ্চলে একটা কীটনাশক কারখানায় বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হয়ে মারা যান ২০ হাজারের বেশি মানুষ। বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় দুই লাখ মানুষ। এটা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ গ্যাস ট্র্যাজেডি।
জয়প্রকাশ অঞ্চলটি ছিল শহরের দরিদ্র অঞ্চল। এর আশপাশে ছিল ঘনবসতি। অঞ্চলটি হালকা শিল্পকারখানার জন্য উপযোগী ছিল। কিন্তু এই অঞ্চলে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয় একটা ঝুঁকিপূর্ণ কীটনাশক তৈরির কারখানা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেড।
ভূপালের প্রায় ৯ লাখ অধিবাসী তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অন্যদিকে ইউনিয়ন কার্বাইডে শুরু হয়েছে রাতের পালার কাজ। ৩ ডিসেম্বর প্রথম প্রহরে দুর্ঘটনার সূত্রপাত। তখন কারখানায় ১০০ শ্রমিক কাজ করছিলেন। রাত বারোটা নাগাদ শ্রমিকেরা শারীরিক প্রতিক্রিয়া অনুভব করতে শুরু করেন। কীটনাশক কারখানায় এ ধরনের শারীরিক প্রতিক্রিয়া ছিল স্বাভাবিক। শ্রমিকেরা পরিস্থিতি দেখার জন্য চা-বিরতি পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
একটা ট্যাংকের ভেতর চাপ ও তাপ বাড়তে বাড়তে একসময় তা বিপৎসীমার ওপর চলে যায়। সোয়া ১২টার দিকে বিস্ফোরণে কারখানাটি কেঁপে উঠলে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। অতিরিক্ত চাপে ট্যাংকের একটি ভালভ ভেঙে গেলে ভেতর থেকে গ্যাস বের হতে শুরু করে। বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়া রোধ করার উদ্দেশ্যে স্থাপিত যন্ত্র ‘ভেন্ট গ্যাস স্ক্রাবার’ নষ্ট থাকায় কারখানা থেকে বেরিয়ে যায় ৪০ টনের বেশি বিষাক্ত মিথাইল আইসোসায়ানেট গ্যাস।
সে রাতের কুয়াশামাখা শীতল বাতাসে ভর করে ওই গ্যাস ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে নিঃশব্দে। বিষাক্ত গ্যাস মৃত্যুদূতের মতো হানা দেয় ভূপালবাসীর ঘরে ঘরে। দুর্ঘটনার শিকার অধিকাংশই ছিল সমাজের খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ। প্রথমে তাদের নাকে দুর্গন্ধ আসে। ধীরে ধীরে গন্ধ আরও জোরালো হয় এবং তারা ঘুম থেকে জেগে ওঠে। তাদের চোখ জ্বলতে শুরু করে, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। বমি করতে শুরু করে অনেকে। অনেকের মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে শুরু করে। প্রতিটি ঘরবাড়ি ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। শহরে ও শহরতলিতে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। চোখ জ্বলার কারণে চোখ খোলা রাখতে পারছিল না তারা। হাজার হাজার মানুষ দিশাহারা হয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে শুরু করে। কেউ পালাতে পারছিল, আবার কেউ ঘর থেকে বের হয়েই পড়ছিল লুটিয়ে। কোন দিকে গেলে রক্ষা মিলবে, তা কেউ বুঝতে পারছিল না। ফলে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে তারা।
রাত ১টা ১০ মিনিটে ভূপাল রেলস্টেশনে পৌঁছানো লক্ষ্মৌ-মুম্বাই এক্সপ্রেস ট্রেনটি পরিণত হয়েছিল শবাধারে। স্টেশনে বহু লোক পালাতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে মারা যায়। ভোরের আলো ফোটার আগেই মারা যায় হাজার হাজার মানুষ। রাস্তার পাশে পড়ে থাকে শত শত লাশ। মা জানেন না, তাঁর আদরের সন্তান মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। সন্তান জানে না, তার মা-বাবা কোথায়। কিছু কিছু পরিবারের সবাই মারা যায়। পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় মারা যায় ৮ হাজারের বেশি মানুষ। শ্মশানে একসঙ্গে পোড়ানো হয় শত শত লাশ। গণকবরে সমাহিত করা হয় সারি সারি লাশ। বিষাক্ত গ্যাসে আক্রান্ত হয় পাঁচ লাখের বেশি মানুষ। আক্রান্ত মানুষদের অনেকেই পরে মারা যায়। অনেকে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অনেকে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা নিয়ে বেঁচে ছিল।
প্রায় অর্ধেক অন্তঃসত্ত্বা নারীর গর্ভের সন্তান মারা যায়, অনেকের গর্ভপাত ঘটে। যে শিশুরা পৃথিবীর আলো দেখতে পেয়েছিল, তাদের অনেকেই জন্মের পরপরই মারা যায়। মানুষের পাশাপাশি মারা যায় হাজার হাজার পশুপাখি, পাতাহীন হয়ে পড়ে গাছপালা, ঘাসগুলো হয়ে যায় হলদে।
কারখানাটির চেয়ারম্যান ওয়ারেন অ্যান্ডারসন ৭ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে আসেন। তিনি কারখানাটি পরিদর্শন করতে ভূপালে গেলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু গ্রেপ্তারের কয়েক ঘণ্টা পরই জামিনে ছাড়া পেয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান। আর কখনো ভারতে ফিরে আসেননি তিনি। পরবর্তী সময়ে ভারত সরকার ৩৩০ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করে। কিন্তু ইউনিয়ন কার্বাইড মাত্র ৪৭ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দিয়ে দায়মুক্ত হয়। ১৯৯২ সালে ওয়ারেন অ্যান্ডারসনকে পলাতক আসামি ঘোষণা করেন ভারতের আদালত। ২০১০ সালে ভারতের একটা আদালত মামলাটির চূড়ান্ত রায় দেন। আদালত দুর্ঘটনার সময় কর্মরত আটজনকে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং প্রত্যেককে দুই বছর কারাদণ্ড ও এক লাখ রুপি জরিমানা করেন। ওয়ারেন অ্যান্ডারসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ না হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে কোনো শাস্তি ঘোষণা করা হয় না। অ্যান্ডারসন ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় মারা যান।
এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হয় কারখানার পুরোনো সরঞ্জাম, কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা, অপর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিরাপত্তাব্যবস্থার ঘাটতিকে। ঘটনার প্রাথমিক পর্যায়ে কারখানার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ঘটনাটি স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে জানাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ফলে যথাসময়ে শহরের বাসিন্দাদের সতর্ক করা যায়নি।
ভূপালের গ্যাস ট্র্যাজেডি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যায় মারাত্মক অভিশাপ। এত বছর পরও স্থানটি বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবমুক্ত হয়নি। এখনো দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশে শারীরিক বিকলাঙ্গতা ও মানসিক সমস্যা নিয়ে জন্ম নেয় অনেক শিশু। ভূপালের শিশুদের জন্মগত পঙ্গুত্বের হার তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির হারও কম। এই অঞ্চলের মানুষের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার অনেক বেশি। পরিবেশবাদীরা বলে আসছেন, নির্গত বিষের কারণে এখনো এলাকার মাটি ও ভূগর্ভস্থ পানি বিষাক্ত হয়ে আছে।