সংগীতের প্রবাদপুরুষ মহম্মদ রফির জন্ম

মহম্মদ রফি (১৯২৪–১৯৮০)
ছবি: সংগৃহীত

ভারতীয় উপমহাদেশজুড়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী মহম্মদ রফি। তাঁর কণ্ঠস্বরের মধুরতা তাঁকে তাঁর সমসাময়িক শিল্পীদের থেকে আলাদা করে তুলেছে। তাঁকে বলিউডের ইতিহাসে অন্যতম সেরা প্লেব্যাক গায়ক মনে করা হয়। ২০০১ সালে ‘স্টারডাস্ট’ ম্যাগাজিনের উদ্যোগে পাঠকদের ৭০ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি ‘শতাব্দীর সেরা গায়ক’ নির্বাচিত হন। ২০১৩ সালে সিএনএন-আইবিএন সমীক্ষায় রফিকে হিন্দি সিনেমার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পী নির্বাচিত করা হয়।

মহম্মদ রফির জন্ম ১৯২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর, অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাবের ‘কোটলা সুলতান সিং’ নামের একটা ছোট্ট গ্রামে। সেই গ্রামে আসা এক ফকিরের গান শুনে অল্প বয়সে গানের প্রতি ঝুঁকে পড়েন মহম্মদ রফি। তিনি ফকিরের ভজনগান অনুকরণ করে গাইতে থাকেন।

১৯৩৫ সালে রফি তাঁর পরিবারের সঙ্গে লাহোরে চলে যান। কিশোর রফির গান তাঁর বড় ভাইয়ের বন্ধু হামিদকে আলোড়িত করে। লাহোরে গিয়ে হামিদের অনুপ্রেরণায় গান শিখতে শুরু করেন রফি। ১৫ বছর বয়সে একটি ঘটনা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। রফি আর হামিদ গায়ক কে এল সায়গলের একটা অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় কে এল সায়গল সাউন্ড সিস্টেম ছাড়া গান গাইতে অস্বীকার করেন। তখন হামিদ আয়োজকদের রাজি করিয়ে রফির গান গাওয়ার ব্যবস্থা করেন। রফি খালি গলায় গান গেয়ে শ্রোতাদের মাতিয়ে রাখেন। শ্রোতারা রফির কাছে একের পর এক গান গাওয়ার অনুরোধ করতে থাকেন। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রখ্যাত সুরকার ও সংগীত পরিচালক শ্যাম সুন্দর। তিনি রফির প্রতিভায় মুগ্ধ হন। তরুণ রফিকে তাঁর সিনেমায় গান গাওয়ার আমন্ত্রণ জানান।

পাঞ্জাবি চলচ্চিত্র ‘গুল বালুচ’-এ জিনাত বেগমের সঙ্গে গাওয়া ‘সোনিয়ে নি হেরিয়ে নি’ গানের মাধ্যমে রফির সংগীতজীবনে আত্মপ্রকাশ। এর কিছুদিন পর লাহোরের অল ইন্ডিয়া রেডিওতে গান গাওয়ার সুযোগ হয় তাঁর।

১৯৪৪ সালে রফিকে নিয়ে বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) চলে যান হামিদ। সেখানে গিয়ে রফি বিখ্যাত সংগীতজ্ঞদের কাছ থেকে তালিম নিতে শুরু করেন। ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খান, ওস্তাদ আবদুল ওয়াহিদ খান, পণ্ডিত জীবন লাল মটটু ও ফিরোজ নিজামির মতো মহান সংগীতজ্ঞদের কাছ থেকে শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নেন তিনি। ‘গাঁও কি গোরি’ সিনেমায় গান গাওয়ার মধ্য দিয়ে তাঁর নতুন পথচলা শুরু হয়।

বিখ্যাত সংগীত পরিচালক নওশাদের সান্নিধ্যে মহম্মদ রফি নিজেকে তখনকার হিন্দি সিনেমার ভুবনে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও সবচেয়ে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। নওশাদ ছাড়া তিনি বিভিন্ন সময় ও পি নাইয়ার, শংকর জয়কিষাণ, শচীন দেববর্মন, মদনমোহন, রওশানসহ বিভিন্ন সংগীত পরিচালকের পরিচালনায় গান করেছেন।

রফির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি ছবির অভিনেতার কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে গান গাইতে পারতেন। তা ছাড়া গানের দৃশ্যের অভিনেতা কখন কী করবেন, এ বিষয়ে অনুমান করার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। তাঁর সময়ে শীর্ষ সব তারকা অভিনেতার গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। বোম্বেতে জীবনের প্রথম দিকে নূরজাহানের মতো শিল্পীর সঙ্গে গান করেছেন রফি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর নূরজাহান পাকিস্তানে চলে গেলে তিনি অন্য শিল্পীদের সঙ্গে জুটি বাঁধেন। লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে রফির জুটিকে বলা হয় বলিউডি সিনেমার ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ গায়ক জুটি। ১৯৪৯ সালের ‘বরসাত’ সিনেমা থেকে শুরু করে রফির মৃত্যু পর্যন্ত অসংখ্য দ্বৈত গানে অংশ নেন তাঁরা। তা ছাড়া আশা ভোঁসলের সঙ্গে রফি প্রায় এক হাজার গানে কণ্ঠ দিয়েছেন।

প্লেব্যাক সংগীত ছাড়া শাস্ত্রীয় সংগীত, কাওয়ালি, ভজন, গজলসহ বিভিন্ন ধরনের সংগীতেও পারদর্শী ছিলেন রফি। ৪০ বছরের সংগীতজীবনে তিনি প্রায় ২৬ হাজার গান গেয়েছেন। হিন্দি ভাষা ছাড়া বাংলা, উর্দু, অসমিয়া, ভোজপুরি, উড়িয়া, পাঞ্জাবি, মারাঠি, সিন্ধি, কন্নড়, গুজরাটি, তেলেগু, মাগ্ধী, মৈথিলি ইত্যাদি ভাষায় গান গেয়েছেন। এ ছাড়া ইংরেজি, ফারসি, স্প্যানিশ এবং ডাচ ভাষায়ও গান তুলেছেন কণ্ঠে। বাংলা ভাষায় বিভিন্ন সুরকারের সুরে অনেক গান আছে তাঁর। তাঁর গাওয়া নজরুলগীতির একটা অ্যালবামও আছে।

মহম্মদ রফি ছিলেন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। অনেকবার সংগীত পরিচালকদের কাছ থেকে এক পয়সাও না নিয়ে গান করেছেন। গরিব ও অসহায় শিল্পীদের আর্থিক সহায়তার জন্য অনেক দাতব্য অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। পরিবারের প্রতি অত্যন্ত দায়িত্বশীল ছিলেন রফি। রেকর্ডিং স্টুডিও থেকে বাড়ি এবং বাড়ি থেকে রেকর্ডিং স্টুডিওতেই তাঁর চলাচল সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণত কোনো পার্টিতে যেতেন না। আর সৌজন্য রক্ষার জন্য গেলেও অল্প সময়ের মধ্যে বাসায় ফিরে যেতেন। ১৯৪৫ সালে তিনি তাঁর চাচাতো বোন বশিরাকে বিয়ে করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় রফি ভারতে থেকে যান। তিনি তাঁর অবশিষ্ট পরিবারকে লাহোর থেকে ভারতে স্থানান্তর করেন। তবে দেশভাগের আগে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বশিরার মা–বাবার মৃত্যু হলে তিনি ভারতে যেতে রাজি হন না। বোম্বেতে থাকাকালে রফি ও হামিদ এক পরিবারের দুই বোনকে বিয়ে করেন।

মহম্মদ রফি তাঁর গৌরবময় সংগীতজীবনে অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। শুরুর দিকে ফিল্মফেয়ার কর্তৃপক্ষ শুধু একজন কণ্ঠশিল্পীকে বছরের সেরা গায়ক নির্বাচন করত। ষাটের দশকে রফি ছয়বার এই পদক পান। ১৯৬৭ সালে ভারত সরকারের ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে ভূষিত হন তিনি। সংগীত পরিচালক রাভির সুরে ‘নীল কমল’ সিনেমায় গান গেয়ে ১৯৭৭ সালে সেরা গায়ক হিসেবে ভারতের জাতীয় পুরস্কার পান। সত্তরের দশকে গলার কিছু সমস্যার জন্য গান গাওয়া অনেকটাই কমিয়ে দেন তিনি। তখন কিশোর কুমারের আবির্ভাব হলে প্লেব্যাক সংগীতে কাজও কমে যায় তাঁর।

১৯৮০ সালের ৩১ জুলাই মাত্র ৫৫ বছর বয়সে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয় এই জনপ্রিয় সংগীতশিল্পীর। ভীষণ বৃষ্টিপাতের মধ্যেও তাঁর শেষকৃত্যে হাজার হাজার লোকের সমাগম হয়। তাঁকে বোম্বের জুহুর একটা কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। তাঁকে সম্মান জানাতে রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয় দুই দিন ধরে।

লন্ডনের এক থিয়েটারে এক অন্ধ শ্রোতা রফির গান শুনে বলেছিলেন, ‘যত দিন আমার কান শুনতে পাবে, তত দিন আমার চোখের প্রয়োজন হবে না।’ এই অন্ধ শ্রোতার মতো প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁর সুরের মূর্ছনায় মোহিত হয়ে আছে। সংগীতবিশ্ব তার উজ্জ্বলতম আলোকিত ব্যক্তিদের একজনকে হারিয়েছে ঠিকই কিন্তু তাঁর সুরেলা কণ্ঠ এখনো সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়কে রাঙিয়ে রেখেছে।