বন্ধুর বিয়েতে আমার স্ত্রী যা দিতে চাইল আর আমি যা দিলাম

আঁকা: আসিফ

সৈকত–তিথি নতুন বাসায় উঠেছে। আমরা যাব ওদের ওখানে। সৈকতের বিয়ে হয়েছে প্রায় সপ্তাহখানেক। অফিসের ব্যস্ততার জন্য বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়া হয়নি। এখন না গেলেই নয়।

বিয়ের পর নবদম্পতির বাসায় যাব, গিফট-টিফটের বিষয় আছে। তার ওপর সৈকত আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।

শিমু বলল, ‘ভাবো তো কী দেওয়া যায়।’

আমি কিছু না ভেবেই বললাম, ‘এক কাজ করি চলো, একটা ডিনার সেট দিই।’

শিমু ভুরু কুঁচকে বলল, ‘ডিনার সেট দেওয়ার কথা বলার সময় কেউ “এক কাজ করি চলো” বলে না! যেভাবে “এক কাজ করি চলো” বললা, তাতে মনে হলো জেমস ওয়েবের টেলিস্কোপে দেখা গ্যালাক্সি–ফ্যালাক্সি থেকেই কিছু একটা দেওয়ার প্ল্যান–টেলান করতেছ!’

আমি ঢোক গিলে বললাম, ‘তাহলে তুমিই বলো।’

‘তোমার বন্ধুর পছন্দ–অপছন্দ তোমারই ভালো জানার কথা। তবে যা-ই দাও না কেন, সেটা যেন ইউনিক, কাজের এবং অবশ্যই আমাদের কথা মনে করানো টাইপের হয়। আল্লাহর ওয়াস্তে ডিনার সেট ফিনার সেটের কথা মাথা থেকে বাদ দাও।’

‘গিফট–টিফটের বিষয়ে আমি বলা যায় গণ্ডমূর্খ। তার ওপর রুচির অবস্থাও যা–তা। কালার সেন্স বলতে “খাকি কালারের প্যান্টের সঙ্গে কালো শার্ট ভালো মানায়” পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। আর “নবদম্পতি” বললেই কেন জানি চোখের সামনে খালি টকটকা লাল রং ভাসে! কাজেই আমার “মাথা আউলানো” অবস্থা হলো।’

মোটামুটি একটা লিস্টি করে উপহার কিনতে শুরু করলাম। শিমুর ‘ইউনিক, কাজের এবং আমাদের কথা মনে করানো’–টাইপ সব গিফট। এক একটা গিফট কিনছি আর মনে মনে আমার ‘বুদ্ধি’ দেখে শিমুর ঝলমলে মুখের কথা ভেবে ভেবে আহ্লাদিত হচ্ছি।

উপহারের ঢাউস সাইজের বাক্স দেখেই শিমু আঁতকে উঠে বলল, ‘আল্লাহ! কী নিয়ে আসছ তুমি?’

আমি লজ্জিত মুচকি হাসি দিয়ে বললাম, ‘খুলেই দেখো।’

বাক্স খুলে প্রথম জিনিসটা হাতে নিয়ে শিমুর মুখ হাঁ হয়ে গেল। আর্তচিৎকারের মতো করে বলে উঠল, ‘আল্লাহ! কী এগুলা?’

শিমু যেগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে আশ্চর্যবোধক ‘কী’ করছিল, ওগুলো ক্যালকুলেটর। মোটমাট দুইটা। ক্যাসিও এফএক্স–১০০ এমএস, আর ক্যাসিও সুপার এফএক্স।

শিমুকে বললাম, ‘ওদের নতুন সংসার। এখন খরচাপাতি খুবই হিসাব করে করা দরকার। তাই ক্যালকুলেটর। উপহার হিসেবে অবশ্যই ইউনিক এবং কাজের। আর যতবার ওরা হিসাব–নিকাশ করবে, ততবার আমাদের কথা মনে পড়তে বাধ্য। দরকার হলে ক্যালকুলেটরের গায়ে আমার আর তোমার নাম লিখে দেব। এস+এস।’

শিমু কিছু একটা বলতে নিচ্ছিল। আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘দুইটা কেন, সেটা তো? বলছি। নরমালটা দিয়ে টুকটুক করে হিসাব-কিতাব করবে। বাকিটা প্রোগ্রামেবল। তুমি তো জানোই, সৈকতের ম্যাথ কত প্রিয়। মন খারাপ থাকলেই ও ম্যাথ করে। এখন তো অল্পতেই মনটন খারাপ হবে। ওই সময় যাতে সহজে ইন্টিগ্রেশন, ডিফারেন্সিয়েশন করে মনটা হালকা করতে পারে, এ জন্য প্রোগ্রামেবল। আর শুনেছি, ওর ওয়াইফও বিবিএ-এমবিএ করা। মুড সুইংয়ের সময়ে সে–ও চাইলে ডেবিট–ক্রেডিট করতে পারবে।’

জানোই তো, হাতের কাছে কলম না থাকলে মেজাজ বিগড়ে যায়। ওদের এখন কোনোভাবেই মেজাজ বিগড়ানো ঠিক হবে না। এটা–সেটা কাটতে কাঁচি লাগে। চাকু লাগে আরও বেশি। কাপড়টাপড় তো যখন তখন ছিঁড়ে–ফেটে যায়। তার জন্য সুঁই–সুতা। তীব্র গরমে নিচে পাটি দিয়ে শুতে পারবে। ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধের জন্য জ্বালানির সংকট দেখা দিচ্ছে...

শিমু আমার কথা শুনছে বলে মনে হলো না। চোখমুখ অন্ধকার করে একটার পর একটা ‘গিফট’ বের করতে লাগল এবং আগের চেয়ে অধিকতর অন্ধকারাচ্ছন্ন চোখমুখ নিয়ে আমার দিকে তাকাতে থাকল।

হরেক রকমের সেফটিপিনের চমৎকার ছোট বাক্স। দুইটা ছোট–বড় কাঁচি। কারুকার্য করা চাকু দুইটা। সুঁই–সুতার একটা সুন্দর বাক্স। হাঁড়ি–পাতিল ধরার ফুলতোলা ন্যাকড়া হাফ ডজন। একটা ব্রান্ডের শু ব্রাশ। হেয়ার ড্রায়ার। দুইটা হাতপাখা। একটা শীতলপাটি। দুইটা টেবিল ক্লথ। একটা চার্জার লাইট। ব্যাটারিচালিত ফ্যান।

শিমুর অন্ধকারাচ্ছন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললাম, ‘জানোই তো, হাতের কাছে কলম না থাকলে মেজাজ বিগড়ে যায়। ওদের এখন কোনোভাবেই মেজাজ বিগড়ানো ঠিক হবে না। এটা–সেটা কাটতে কাঁচি লাগে। চাকু লাগে আরও বেশি। কাপড়টাপড় তো যখন তখন ছিঁড়ে–ফেটে যায়। তার জন্য সুঁই–সুতা। তীব্র গরমে নিচে পাটি দিয়ে শুতে পারবে। ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধের জন্য জ্বালানির সংকট দেখা দিচ্ছে। যখন–তখন লোডশেডিং হয়। তাই চার্জার লাইট, হাতপাখা আর ব্যাটারিচালিত ফ্যান...।’

আমার কথার মাঝখানেই শিমু উঠে পার্স হাতে নিয়ে বাইরে চলে গেল। র‍্যাপিং পেপারে মোড়ানো একটা বাক্স হাতে নিয়ে ফিরল ঘণ্টা দুয়েক পর। আমি খুব আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাইলাম, ‘কী এনেছ?’

শিমু আগ্রহের ধার ধারল না। থমথমে মুখে আমাকে বলল, ‘রেডি হও।’

আমি গায়ে পাঞ্জাবি চাপালাম। শিমুও শাড়ি পরছে। আকাশি রঙের এই জামদানি শাড়িটা পরলে ওকে যে কী মায়াবতী লাগে!

কিন্তু শিমুর শাড়ির ভাঁজটাজ ঠিক হচ্ছে না। বারবারই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আমি মিনমিন করে বললাম, ‘ওখান থেকে সেফটি পিন দিয়ে না হয় ঠিক করে নাও।’

শিমু নিঃশব্দে দুই-তিনটা সেফটিপিন তুলে নিয়ে শাড়ির ভাঁজ ঠিক করল। আমার দিকে তাকিয়ে শাড়ির নিচের দিক থেকে বের হওয়া কিছু সুতা দেখিয়ে বলল, ‘এগুলোর কী করব?’

আমি নতুন কেনা কাঁচি এগিয়ে দিলাম।

সুতা কেটে শিমু বলল, ‘তোমার ওখানে কত খরচ হলো?’

আমি একটা একটা হিসাব করতে লাগলাম। কিন্তু বারবারই আটকে যাচ্ছি। শিমু লিপস্টিক দিতে দিতে ক্যালকুলেটর বের করে হাতে দিয়ে বলল, ‘এটা দিয়ে হিসাব করো।’

আর ঠিক তখনই বিদ্যুৎ চলে গেল!

শিমু কণ্ঠে চরম বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘হইছে কাজ!’

আমি তড়িঘড়ি করে চার্জার লাইট অন করলাম। সঙ্গে শিমুর দিকে তাক করলাম ব্যাটারিচালিত ফ্যান। ওর চুল উড়ছে। চার্জার লাইটের আলোআঁধারিতে শিমুকে দেখাচ্ছে পরির মতো! আমার বুকের রক্ত ছলাৎ করে উঠল।

ও আয়নায় হ্যাবলাভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘থ্যাংক ইউ!’

শিমুর র‍্যাপিং পেপারে মোড়ানো বাক্স হাতে নিয়ে বের হয়েছি। ও হাতের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘অন্য বাক্সটা কই!’

আমি চোরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কোন বাক্স?’

ও লাজুক হেসে বলল, ‘ইউনিক, কাজের আর আমাদের কথা মনে করানো গিফটের বাক্স!’

আমার বুকের রক্ত আরেকবার ছলাৎ করে উঠল!