পুনরায় উন্মুক্ত হলো জার্মানির ব্র্যান্ডেনবার্গ গেট

১৯৮৯ সালের ২১ ডিসেম্বর রাতে ব্র্যান্ডেনবার্গ গেটের পাশে বার্লিন ওয়ালের একটি অংশ সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

পূর্বে সমাজতন্ত্র, পশ্চিমে পুঁজিবাদ—এই দুই বিপরীতধর্মী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে বিভাজনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কংক্রিটের এক প্রাচীর। এটি ছিল পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানিকে পৃথক করা বার্লিনের প্রাচীর। মিত্রদেশগুলোর মধ্যস্থতায় পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির নেতাদের ধারাবাহিক আলোচনার পর দুই জার্মানি আনুষ্ঠানিকভাবে আবারও একীভূত হয় ১৯৯০ সালের অক্টোবর মাসে। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে এই মিলন সংঘটিত হয়েছিল ১৯৮৯ সালের ২২ ডিসেম্বর, যেদিন বার্লিনের ব্র্যান্ডেনবার্গ গেটটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর হেলমুট কোহল পূর্ব জার্মানির প্রধানমন্ত্রী হ্যান্স মডরোর সঙ্গে দেখা করতে এর মধ্য দিয়ে হেঁটে যান।

১৯৮৯ সালে ব্র্যান্ডেনবার্গ গেটের ঠিক সামনে ভেঙে ফেলা বার্লিন ওয়াল
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

১৯৪৫ সালের ৮ মে জার্মানির একনায়ক হিটলারের আত্মহননের মধ্য দিয়ে শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তখন মিত্রবাহিনীর চার শক্তির দখলে আসে জার্মানি। যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানিকে চারটি আলাদা অংশে বিভক্ত করে ফেলে। সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হয়ে ওঠে পূর্ব জার্মানি। অন্য তিন অঞ্চলের সমন্বয়ে গঠিত হয় পশ্চিম জার্মানি। শুরুতে দুই জার্মানির জনগণ উভয় জার্মানির ভেতর অবাধে চলাচল করতে পারলেও ১৯৫২ সাল থেকে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ১৯৬১ সালে প্রথমে কাঁটাতারের বেড়া তৈরির মাধ্যমে সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়, পরবর্তী সময়ে কাঁটাতারের বেড়ার জায়গায় কংক্রিটের দেয়াল গড়ে ওঠে।

মূলত পশ্চিম জার্মানির নাগরিকেরা যাতে পূর্ব জার্মানিতে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য পূর্ব জার্মানির সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রাচীর নির্মাণ করে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যত জন পশ্চিম জার্মানির নাগরিক পূর্ব জার্মানিতে প্রবেশ করছিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক পূর্ব জার্মানির নাগরিক পশ্চিম জার্মানিতে প্রবেশ করছিলেন।

আশির দশকের শেষ দিকে পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন শুরু হয়। সেই পরিবর্তনের ঢেউ লাগে পূর্ব জার্মানিতেও। অধিকতর গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারের দাবির পাশাপাশি দাবি ওঠে পশ্চিম জার্মানি ভ্রমণের। ১৯৮৯ সালের ৯ অক্টোবর পূর্ব জার্মানির লাইপজিগ শহরে নাগরিক আন্দোলনের ডাকে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন।

ব্র্যান্ডেনবার্গ গেট বার্লিনের প্রধান ঐতিহ্য
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

এরপর ছোট-বড় অনেক শহরে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েন। ৪ নভেম্বর পূর্ব বার্লিনের প্রাণকেন্দ্র আলেক্সান্ডার স্কয়ারে প্রায় ১০ লাখ মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। লাগাতার বিক্ষোভের মুখে ৯ নভেম্বর পূর্ব জার্মানি সরকার নাগরিকদের পশ্চিম জার্মানি যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন। টেলিভিশনে এই সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই জার্মানির জনগণ প্রাচীরের উভয় পাশে জড়ো হতে থাকেন। উৎসাহী জনতা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রাচীরের বেশ কিছু অংশ ভেঙে ফেলেন।

বার্লিনের ব্র্যান্ডেনবার্গ গেটকে জার্মানির বিভাজন ও দুই জার্মানির আবার একত্রীকরণ—উভয়ের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি এখনো বার্লিনের প্রধান ঐতিহ্য। শুধু জার্মানি নয়, ইউরোপীয় ঐক্য ও শান্তির প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে ব্র্যান্ডেনবার্গ গেট। গেটটি ১৭৮৮ ও ১৭৯১ সালের মধ্যে প্রুশিয়ান রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের নির্দেশে নির্মিত হয়েছিল এবং শহরের মূল প্রবেশদ্বার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। গেটটির উচ্চতা ২০ মিটার, দৈর্ঘ্য ৬৫ মিটার ও প্রশস্ত ১১ মিটার।

গেটের ওপর রোমান দেবী ‘ভিক্টোরিয়া’ এবং দেবীকে বহনকারী ‘কোয়াড্রিগা’র মূর্তি যুক্ত করা হয়েছিল, যেখানে বিজয়ী দেবী ভিক্টোরিয়া চারটি ঘোড়ায় টানা রথ কোয়াড্রিগা চালাচ্ছেন। ১৮০৬-০৮ সালে বার্লিন দখলের সময় ফরাসি সেনাপতি নেপোলিয়ন মূর্তিটি প্যারিসে নিয়ে যান। মূর্তিটি ১৮১৪ সাল পর্যন্ত প্যারিসে ছিল। এরপর মূর্তিটি বার্লিনে ফিরিয়ে আনা হয় এবং পুনরায় ব্র্যান্ডেনবার্গ গেটের ওপর স্থাপন করা হয়। পুরো কাঠামোটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। পরবর্তী সময় ১৯৫৭-৫৮ সালে এটি সংস্কার করা হয়।

১৯৮৭ সালের ১২ জুন ব্র্যান্ডেনবার্গ গেটের সামনে বক্তৃতা দিচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার দুই বছর আগে ১৯৮৭ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান বার্লিনের ৭৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ব্র্যান্ডেনবার্গ গেটের সামনে বিখ্যাত বক্তৃতা করেন, যেখানে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নকে ‘অশুভ সাম্রাজ্য’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং সোভিয়েত নেতাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘মিস্টার গর্বাচেভ, এই প্রাচীর ভেঙে ফেলুন।’