ক্রুসেড বলতে মূলত বোঝায় ধর্মযুদ্ধ। একাদশ শতকের শেষ দিকে শুরু হয়ে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত মুসলিম ও ইউরোপীয় খ্রিষ্টানদের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে সংঘটিত ধর্মযুদ্ধগুলোকে বলা হয় ক্রুসেড। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্রুসেড কেবল ধর্মযুদ্ধ ছিল না; বরং ভৌগলিক ও ধর্মীয়ভাবে বিভক্ত দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিবাদ থেকে ক্রুসেডগুলো সংঘটিত হয়েছিল। তা ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ও ক্ষমতা বিস্তার ছিল ক্রুসেড সংঘটিত হওয়ার অন্যতম কারণ।
মধ্যযুগে ইউরোপের খ্রিষ্টানদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইসলামের প্রসার। অষ্টম শতকের মধ্যেই ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীর, উত্তর আফ্রিকা ও স্পেনের অধিকাংশ অঞ্চল মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে আসে। অন্যদিকে ইউরোপের জনগণের ওপর খ্রিষ্টধর্মের প্রভাবও বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইসলামের প্রসারের কারণে খ্রিষ্টধর্মীয় নেতারা ইউরোপের জনগণকে একতাবদ্ধ করতে সক্ষম হন।
মুসলিমদের কাছে জেরুজালেম শহর পবিত্র ভূমি হিসেবে বিবেচিত। এ শহরের আল-আকসা মসজিদ মুসলিমদের অন্যতম প্রধান তীর্থস্থান। খ্রিষ্টানদের কাছেও জেরুজালেম শহরটি অন্যতম পবিত্র ভূমি। খ্রিষ্ট্রীয় বিশ্বাস অনুসারে জেরুজালেমে যিশু খ্রিষ্টের মৃত্যু হয়েছিল এবং তাঁকে সমাহিত করা হয়েছিল সেখানেই। শত শত বছর ধরে জেরুজালেমের সেপালকার গির্জায় খ্রিষ্টানরা প্রার্থনা করার জন্য আসতেন। ইসলাম ধর্মের প্রসারের পর জেরুজালেমসহ এ সব পবিত্র ভূমি মুসলিমদের অধীনে ছিল।
মুসলিমদের দখলে থাকলেও জেরুজালেমের তীর্থস্থানে খ্রিষ্টানরা যেতে পারত বিনা বাধায়। কিন্তু ১০৭৭ সালে আনাতোলিয়ার সেলজুক শাসকেরা খ্রিষ্টানদের জেরুজালেমে যেতে বাধা দেণ। এ ঘটনায় পোপ দ্বিতীয় আরবান ক্ষুব্ধ হন। তা ছাড়া বাইজেনটাইন সম্রাট প্রথম অ্যালেক্সিয়াসের ভয় ছিল, সেলজুক সাম্রাজ্য তাঁর এলাকা দখল করে নিতে পারে। তাই তিনি সেলজুক সাম্রাজ্যের বিস্তার প্রতিহত করতে পোপের সাহায্য চান। অ্যালেক্সিয়াস পোপকে বোঝাতে সক্ষম হন যে সেলজুক সাম্রাজ্যের প্রসার কনস্টান্টিনোপলের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে।
১০৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর ফ্রান্সের ক্লেরমন্ট শহরে পোপ দ্বিতীয় আরবান এক জ্বালাময়ী বক্তৃতার মাধ্যমে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, খ্রিষ্টানরা যদি জেরুজালেম উদ্ধার করতে যুদ্ধে যান, তাহলে ঈশ্বর তাঁদের অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন।
পোপের এই ঘোষণার পর ইউরোপের বহু যোদ্ধা ধর্মযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। নিয়মিত যোদ্ধাদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও অস্ত্র হাতে তুলে নেন। তাঁরা যে সবাই ধর্মীয় কারণে যুদ্ধে যেতে সম্মত হয়েছিলেন, বিষয়টি তেমন নয়। বরং ইউরোপের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা বিজয় থেকে অর্জিত ভূমি এবং বাণিজ্যিক কারণে সাধারণ মানুষকে যুদ্ধে প্রলুব্ধ করেছিলেন। এদিকে সম্রাট অ্যালেক্সিয়াস পোপের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেন যে যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে যেসব এলাকা দখল করা হবে, সেসব এলাকা তাঁর সাম্রাজ্যের অংশ হবে।
দুই শতাব্দী ধরে চলা আটটি ক্রুসেডের মধ্যে প্রথমটি শুরু হয় ১০৯৬ সালে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ক্রুসেডাররা জেরুজালেম উদ্ধারের জন্য রওনা হন। পবিত্র ভূমিতে যাওয়ার সময় তাঁরা বহু নিরপরাধ লোককে হত্যা করেন। প্রায় ৭৫ হাজার ক্রুসেডার বাহিনী সেলজুক রাজধানী নিকায়া দখল করে। এরপর তারা বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে জেরুজালেমের দিকে অগ্রসর হয়। তখন জেরুজালেমের দায়িত্বে ছিলেন মিসরীয় ফাতিমি শাসক ইফতিখার আদ-দুলা। তাঁর অধীনে ছিল সহস্রাধিক সৈনিক আর ৪০০ অশ্বারোহী। দীর্ঘ অবরোধ শেষে ১০৯৯ সালে জেরুজালেমের শাসক আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। মূলত সৈন্যসংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় ক্রুসেডার বাহিনী প্রশিক্ষিত মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করে।
জেরুজালেম দখল করে ক্রুসেডাররা নিষ্ঠুর আক্রমণ চালিয়ে কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করেন। নিহত মানুষদের মধ্যে অনেক শিশু ও নারী ছিল। ক্রুসেডার বাহিনী ইহুদি ধর্মের উপাসনালয়ে আশ্রয় নেওয়া ইহুদিদেরও হত্যা করে। ক্রুসেডার বাহিনী জেরুজালেম দখল করে সেখানে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে। জেরুজালেম পতনের দুই সপ্তাহ পর এবং বিজয়ের খবর ইউরোপে ফিরে আসার আগেই পোপ দ্বিতীয় আরবান মারা যান।