জর্জ বার্নার্ড শর মৃত্যু

জর্জ বার্নার্ড শ
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম সেরা নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ। সমসাময়িক ব্যঙ্গ রচনা থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক রূপক কাহিনিতেও তিনি খ্যাতিমান। ২০১৬ সালে বব ডিলান সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগপর্যন্ত শ–ই একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন, যিনি একাধারে নোবেল ও অস্কার পেয়েছেন।

জর্জ বার্নার্ড শর জন্ম ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই, আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন শহরের একটা দরিদ্র পরিবারে। মা লুসিন্ডা এলিজাবেথ ও বাবা জর্জ কার শ–র তৃতীয় এবং সর্বকনিষ্ঠ সন্তান তিনি। ছোটবেলায় এক চাচার কাছে পড়াশোনায় হাতেখড়ি। ১৮৬৫ থেকে ১৮৭১ সালের মধ্যে শ চারটি স্কুলে ভর্তি হলেও কোনো স্কুলে বেশি দিন পড়াশোনা করেননি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অপছন্দ করলেও ছোটবেলা থেকে তাঁর বই পড়ার নেশা ছিল প্রচণ্ড। স্কুলের পড়াশোনা বাদ দিয়ে ১৬ বছর বয়সে তিনি একটা ভূমি ব্যবসায়ীর অফিসে কেরানি হিসেবে যোগ দেন।

শর মা ছিলেন গায়িকা। বাদকদলের পরিচালক ও গানের শিক্ষক জর্জ জন লি ডাবলিনে এলে লির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তখন তাঁদের বাড়িটা প্রায়ই গায়ক ও বাদকদলের সংগীতে জমজমাট থাকত। গায়ক ও বাদক দলের সদস্যরা শ–কে বিভিন্ন বই দিতেন, শ বইগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। এভাবে শ ছোটবেলায় সংগীত ও গীতিনাটকের দুনিয়ার সঙ্গে পরিচিত হতে থাকেন, যা ভবিষ্যতে তাঁকে নাটক লেখার অনুপ্রেরণা জোগায়। ১৮৭৩ সালে লি লন্ডনের উদ্দেশে ডাবলিন ছেড়ে যান। এর কিছুদিন পর শর মা তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে চলে যান লির কাছে।

১৮৭৬ সালে শ তাঁর মায়ের কাছ থেকে জানতে পারেন, তাঁর বোন অ্যাগনেস যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুশয্যায়। তখন তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে লন্ডনে মায়ের কাছে চলে যান। লন্ডনে গিয়ে তাঁর অর্থের প্রয়োজন হয়। তাই ভাবতে শুরু করেন লেখালেখির কথা। সে সময় তিনি ব্রিটিশ মিউজিয়ামের পাঠকক্ষে (পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ লাইব্রেরি) একটি ছোট কাজ পান। সেখানে তিনি কাজের পাশাপাশি পড়ালেখা করেই সময় কাটাতেন। এরপর শ যোগ দেন একটা টেলিফোন কোম্পানিতে। কোম্পানিটি অন্য একটি কোম্পানির সঙ্গে একীভূত হলে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন এবং লেখক হিসেবে শুরু করেন পূর্ণ কর্মজীবন।

১৮৭৮ থেকে ১৮৮৩ সাল পর্যন্ত শ পাঁচটি উপন্যাস লেখেন। দিনের পর দিন তিনি এই উপন্যাসগুলোর পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকেন। কিন্তু লন্ডনের কোনো প্রকাশনা সংস্থা তাঁর লেখা ছাপতে রাজি হয় না।

১৮৮২ সালে মার্কিন অর্থনীতিবিদ হেনরি জর্জ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে শ সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। অংশ নিতে শুরু করেন রাজনৈতিক দল সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ফেডারেশনের বিভিন্ন সভায়। যোগ দেন সদ্য প্রতিষ্ঠিত ‘ফ্যাবিয়ান সমাজ’-এ। অল্প সময়ের মধ্যেই খ্যাতি লাভ করেন সুদক্ষ বক্তা এবং যুক্তিবাদী তার্কিক হিসেবে।

১৮৯০ সাল থেকে শ দ্য ওয়ার্ল্ড পত্রিকায় ‘জিবিএস’ ছদ্মনামে সংগীত, নাটক ও শিল্পসমালোচনা লেখা শুরু করেন। ১৮৯২ সালে তাঁর প্রথম নাটক উইডোয়ার্স হাউজেস প্রকাশিত হয়। কিন্তু এই নাটক দর্শক আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়। এরপর তিনি আরও কিছু নাটক লেখেন। ১৮৯৬ সালে তাঁর রচিত ইউ নেভার ক্যান টেল নাটকটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরপর থেকে তিনি নাট্যকার রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন এবং নাটককে নিজের ভাব প্রকাশের মাধ্যমরূপে বেছে নেন।

জর্জ বার্নার্ড শর প্রকাশিত নাটকের সংখ্যা ৬২। এই নাটকগুলো তাঁকে বিশ্বের অন্যতম প্রতিভাবান নাট্যকারের খ্যাতি এনে দেয়। তাঁর নাটকগুলো বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হলো সিজার অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা, মেজর বারবারা, হার্টব্রেক হাউস, ম্যান অ্যান্ড সুপারম্যান, জন বুলস আদার আইল্যান্ড, দ্য ডক্টরস ডায়লামা, গেটিং ম্যারিড, ফানিস ফাস্ট প্লে, পিগম্যালিওন, জেনেভা এবং সেন্ট জোয়ান।

সেন্ট জোয়ান নাটকের জন্য তিনি ১৯২৫ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। শ প্রথমে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেও নোবেল কমিটির অনুরোধে পুরস্কারের পদকটি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পুরস্কারের অর্থ তিনি দান করে দেন। ১৯৩৯ সালে পিগম্যালিয়ন নাটক রচনার জন্য অস্কার পুরস্কার লাভ করেন শ।

শ যা বিশ্বাস করতেন, নাটকের মাধ্যমে তা নির্ভয়ে প্রকাশ করতেন। শ তাঁর রচনায় প্রচলিত ধ্যানধারণার বিরোধিতা করেছেন, সমাজের শোষকশ্রেণির ওপর ব্যঙ্গবিদ্রূপের মাধ্যমে কশাঘাত চালিয়েছেন। নাটকের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা অত্যন্ত দক্ষ ও সুকৌশলে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন শ। এর ফলে তাঁর সমসাময়িক কালে তিনি হয়ে উঠেছিলেন লন্ডনের সবচেয়ে বিতর্কিত ব্যক্তি। জীবনের শেষ ৪৬ বছর তিনি ইংল্যান্ডের হার্টফোর্ডশায়ারের একটি গ্রামে বাস করতেন। ১৯৫০ সালের ২ নভেম্বর এই গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।