চার্লি চ্যাপলিনের বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান

চার্লি চ্যাপলিন (১৮৮৯–১৯৭৭)
ছবি: সংগৃহীত

চার্লি চ্যাপলিন, নামটি বললেই মন ভালো হয়ে যায়। বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম মূকাভিনেতা ও কৌতুকাভিনেতা হিসেবে মানা হয় তাঁকেই। অসাধারণ অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শককে মুগ্ধ করে গেছেন জীবনভর। আজও তাঁর অভিনয় বিনোদনের অন্যতম খোরাক। কেবল হাস্যরস নয়, ভাবনার নতুন দুয়ারও খুলে যায় তাঁর সৃষ্টি চাক্ষুষ করে। নির্বাক সিনেমা যুগের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব চ্যাপলিন নিজের সিনেমায় নিজেই অভিনয় করতেন, পরিচালনা ও প্রযোজনা করতেন। চিত্রনাট্য, সংলাপ রচনা ও সংগীত পরিচালনাও করেছেন তিনি।

চার্লি চ্যাপলিনের প্রকৃত নাম চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন। চ্যাপলিনের জন্মতারিখ ও জন্মস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা থেকে গেছে। তবে ধারণা করা হয়, চ্যাপলিনের জন্ম ১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল লন্ডনের ওয়ালওর্থে। ছেলেবেলা কেটেছে প্রচণ্ড দারিদ্র্যে। মা-বাবা দুজনই মঞ্চে অভিনয় ও গান করতেন। বয়স তিন বছর হওয়ার আগেই মা-বাবা আলাদা বসবাস করতে শুরু করেন। শিশু চ্যাপলিন ও তাঁর সৎ ভাই সিডনিতে মায়ের সঙ্গেই থাকতেন।

চ্যাপলিনের মা অভিনেত্রী হিসেবে সাফল্যের মুখ দেখেননি। বাবা কোনো আর্থিক সহযোগিতা না করায় চ্যাপলিনের মা সেবিকা ও পোশাক তৈরির কাজ করে সন্তানদের লালনপালন করতে থাকেন। কয়েক বছর যেতে না যেতেই তাঁর মা শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হলে দুই ভাই অসহায় হয়ে পড়েন। তাঁদের ভরণপোষণ ও দেখাশোনার কেউ ছিল না। তাই চ্যাপলিনের বয়স যখন সাত, তখন ভাইসহ তাঁকে একটা কর্মশালায় পাঠানো হয় কাজের জন্য। এরপর কর্তৃপক্ষ তাঁদেরকে পাঠায় সেন্ট্রাল লন্ডন ডিস্ট্রিক্ট স্কুলে।

চ্যাপলিনের মা কোনোদিনই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি। তবে মাঝেমধ্যে কিছুটা সুস্থ হলে তাঁকে বাড়িতে নিয়ে আসা হতো। কিছুদিনের জন্য দুই ভাই বাবার কাছে গেলেও মদ্যপ বাবার কাছে বেশি দিন ঠাঁই হয়নি তাঁদের। চ্যাপলিন মাত্র ৯ বছর বয়সে মায়ের উৎসাহে অভিনয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। চ্যাপলিন বলতেন, ‘মা আমাকে এই বলে অনুপ্রাণিত করতেন যে আমার মধ্যে অনেক প্রতিভা আছে।’

চ্যাপলিন মাত্র ৯ বছর বয়সে ‘দ্য এইট ল্যাঙ্কাশায়ার ল্যাডস’ নামের ছোটদের যাত্রাদলে যোগ দেন। যাত্রাদলে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তাঁর অভিনয়জীবন শুরু। প্রথম থেকেই চ্যাপলিনের মঞ্চাভিনয় দর্শক ও আয়োজকদের নজর কাড়তে থাকে। আর এই অভিনয় ও অন্যান্য কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন চ্যাপলিন। বড় অভিনেতা হওয়ার স্বপ্নটাও দেখতে শুরু করেন তখন থেকে।

১৯০৮ সালে চ্যাপলিন ইংল্যান্ডের ‘ফ্রেড কার্নো’কোম্পানিতে যোগ দেন। এই প্রতিষ্ঠান হাস্যরসাত্মক নাটক তৈরি করে দেশ-বিদেশে প্রদর্শন করে বেড়াত। ওদেরই বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করে চ্যাপলিন নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পান। তাঁর অসাধারণ অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে প্রতিষ্ঠানটি ১৯১০ সালে তাঁকে মঞ্চনাট্য প্রদর্শনীর জন্য পাঠায় যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে ‘জিমি দ্য ফিয়ারলেস’ নামের একটি নতুন নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পান চ্যাপলিন। তাতেই বাজিমাত করেন তিনি, দৃষ্টি কাড়েন গণমাধ্যমের। প্রায় দুই বছর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ করেন দর্শককে। ১৯১২ সালের জুন মাসে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। একই বছর অক্টোবর মাসে আবার যুক্তরাষ্ট্রে যান।

দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্রে গেলে ‘কিস্টোন স্টুডিওজ’-এর একজন প্রতিনিধি তাঁর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হন। ওই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রধান তারকার স্থলে চ্যাপলিনকে অভিনয়ের প্রস্তাবও দেন। ‘মেকিং আ লিভিং’ সিনেমা দিয়ে তাঁর সিনেমায় অভিষেক হয়। দ্বিতীয় সিনেমা থেকেই তিনি তাঁর বিখ্যাত পোশাক নির্বাচন করেন এবং পরিচিতি পান বিশ্বব্যাপী। যুক্তরাষ্ট্রে সফলতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চ্যাপলিন তাঁর মাকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যান। ১৯২৮ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি নিজেই মায়ের সেবা-শুশ্রূষার বিষয়টি দেখভাল করতেন।

দুই বছর কিস্টোন স্টুডিওতে কাজ করার পর চ্যাপলিন বেশি পারিশ্রমিকে শিকাগোর ‘এসানাই স্টুডিও’–তে যোগ দেন। কিস্টোনে তিনি কিছুটা অমার্জিত ও বর্বর প্রকৃতির চরিত্রে অভিনয় করলেও নতুন স্টুডিওর সিনেমায় তাঁকে দেখা যায় মার্জিত ও প্রণয়ধর্মী চরিত্রে। ১৯১৫ সালের ‘দ্য ট্রাম্প’ সিনেমাকে তাঁর নতুনত্বের সন্ধিক্ষণ বলে বিবেচনা করা হয়। ধীরে ধীরে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনন্য ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন চ্যাপলিন। তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে বিশ্বব্যাপী। চলচ্চিত্রশিল্পের অন্যতম প্রধান আন্তর্জাতিক তারকা হয়ে ওঠেন। এরপর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। উপহার দিয়ে গেছেন একের পর এক ব্যবসাসফল সিনেমা। একসময় নিজেই সিনেমা পরিচালনা, প্রযোজনা ও চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করেন। প্রথম দিকে শুধু নির্বাক সিনেমা নির্মাণ করলেও একসময় সবাক চলচ্চিত্র বানাতে শুরু করেন চ্যাপলিন।

চ্যাপলিনের ব্যক্তিগত জীবন ছিল বিতর্কিত ও সমালোচিত। তাঁর খ্যাতি যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, তখন এক পার্টিতে ১৭ বছর বয়সী অভিনেত্রী মিলড্রেড হ্যারিসের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়। কিছুদিন পর হ্যারিস জানান, তাঁর গর্ভে চ্যাপলিনের সন্তান। লোকলজ্জায় ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে হ্যারিসকে বিয়ে করেন চ্যাপলিন। পরে জানা যায়, হ্যারিসের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবরটি মিথ্যা ছিল। চ্যাপলিন এই বিয়েতে সুখী ছিলেন না। ১৯২০ সালে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। ‘দ্য গোল্ড রাশ’ সিনেমা নির্মাণকালে চ্যাপলিন অভিনেত্রী লিটা গ্রেকে বিয়ে করেন। তখন লিটা গ্রের বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। চ্যাপলিনের তৃতীয় স্ত্রী ছিলেন পলেট গডার্ড। গডার্ডের সঙ্গে ছয় বছরের দাম্পত্যজীবন শেষে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়।

১৯৪০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় চ্যাপলিন উঠতি অভিনেত্রী জোন ব্যারির সঙ্গে প্রেমে জড়ান। দুই বছরের প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে গেলে ব্যারি চ্যাপলিনের বিরুদ্ধে তাঁর ঔরসজাত সন্তানের পিতৃত্বের মামলা করেন। সমাজতন্ত্রের প্রতি ঝোঁকের কারণে আগে থেকেই চ্যাপলিন এফবিআইয়ের নজরে ছিলেন। এফবিআই ব্যারির মামলার সঙ্গে চ্যাপলিনের বিরুদ্ধে আরও চারটি অভিযোগ আনে। এর মধ্যে রাজনৈতিক ও নারী পাচারসংক্রান্ত মামলাও ছিল। ব্যারির সন্তান জন্ম নিলে আদালত চ্যাপলিনকে এই সন্তানের বাবা হিসেবে ঘোষণা করেন এবং সন্তানের ভরণপোষণের নির্দেশ দেন।

এই বিতর্কের মধ্যে ৫৪ বছর বয়সী চ্যাপলিন মার্কিন নাট্যকার ইউজিন ও’নিলের ১৮ বছর বয়সী মেয়ে উওনা ও’নিলকে বিয়ে করেন। চ্যাপলিন তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেন, ‘ও’নিলের সঙ্গে সাক্ষাৎ ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত।’ চ্যাপলিন দাবি করেন, ও’নিলের মধ্যে তিনি যথার্থ ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছেন। চ্যাপলিনের মৃত্যু পর্যন্ত ও’নিল তাঁর পাশে ছিলেন এবং এই দম্পতির কোলজুড়ে আসে আট সন্তান।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণে ১৯৫২ সালে চ্যাপলিন সপরিবার যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করেন। পূর্বাভাস দেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে না-ও ফিরতে পারেন, যদিও যুক্তরাষ্ট্রে তিনি রেখে গিয়েছিলেন অঢেল সম্পত্তি। যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করার পর দেশটিতে তাঁর পুনরায় প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়। চ্যাপলিন ইংল্যান্ডে বেশ কিছু সিনেমা নির্মাণ করেন। এরপর তাঁরা সুইজারল্যান্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন।

চ্যাপলিন জীবনে অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। একাডেমি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তিন বার। ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘একাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়ন্সেস’ চ্যাপলিনকে সম্মানসূচক পুরস্কারে ভূষিত করে। প্রথমে দ্বিধা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তিনি পুরস্কার গ্রহণ করতে দীর্ঘ ২০ বছর পর যুক্তরাষ্ট্রে যান। তাঁর প্রত্যাবর্তনের সংবাদ গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং যুক্তরাষ্ট্রে তাঁকে বিরল সম্মানে সম্মানিত করা হয়। শিল্পকলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাঁকে ফ্রান্স সরকার ‘দ্য লিজিওন অব অনার’ সম্মানে ভূষিত করে। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ১৯৭৫ সালে তাঁকে ‘নাইটহুড’ উপাধি দেন।

বার্ধক্যের কারণে চ্যাপলিন ধীরে ধীরে অভিনয় থেকে দূরে চলে যান। ১৯৭৭ সালের অক্টোবরে চ্যাপলিনের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে এবং তিনি একই বছর ২৫ ডিসেম্বর ভোরে ঘুমের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।