জেনারেল আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখল

আইয়ুব খান (১৯০৭–১৯৭৪)
ছবি: সংগৃহীত

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা পাওয়া পাকিস্তানের রাজনীতি কখনো সেনাবাহিনীর প্রভাব থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। বলা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশ শাসন করছে। যেসব সেনা কর্মকর্তা পাকিস্তানকে প্রত্যক্ষভাবে শাসন করেছেন, তাঁদের মধ্যে আইয়ুব খানের নাম প্রথমেই উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তানের রাজনীতিতে আইয়ুব খানের শাসনামল ছিল খুবই ঘটনাবহুল। ১৯৫৮ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি নিজস্ব ধ্যানধারণা থেকে শাসনকার্য পরিচালনা করে আলোচিত ও সমালোচিত হন।

রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল আইয়ুব খানের যোগসাজশে নির্বাচিত সংসদীয় সরকারকে উৎখাত করে পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করেন। তিনি জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন। কিন্তু উচ্চাভিলাষী আইয়ুব খান এতেও সন্তুষ্ট ছিলেন না। এর মাত্র তিন সপ্তাহ পর, ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট মির্জাকে উৎখাত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। এর পরের দিন আইয়ুব খান এক আদেশ জারির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই সাবেক দুজন প্রধানমন্ত্রীসহ অনেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনেন। ইস্কান্দার মির্জাকে বাধ্য করেন দেশ ত্যাগ করতে। আইয়ুব খান নিজের ক্ষমতা পাকাপাকি করার জন্য ১৩ জন জেনারেলকে বরখাস্ত করেন এবং নিজেকে ভূষিত করেন ফিল্ড মার্শাল উপাধিতে। তা ছাড়া রাজধানী করাচি থেকে প্রথমে স্থানাস্তর করেন রাওয়ালপিন্ডিতে, পরে ইসলামাবাদে।

আইয়ুব খান অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নতুন শিল্প–কলকারখানা নির্মাণ, সড়ক নির্মাণ, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুবিধা প্রদান, অনুন্নত শিল্পের জন্য কর রেয়াত সুবিধাও দেন। তাঁর আমলে বৈদেশিক বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্যও নিতে থাকেন নানা পদক্ষেপ। ফলে পাকিস্তানে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। তাঁর শাসনকালকে অখণ্ড পাকিস্তানের সবচেয়ে সফল দশক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ২ হাজার ২০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তান তাঁর এ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে বঞ্চিত হয়, যার ফলে ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধের মাধ্যমে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের।

জেনারেল আইয়ুব ১৯৫৯ সালে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামে নতুন একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু করেন। মৌলিক গণতন্ত্রব্যবস্থায় শাসনকাঠামোকে পাঁচটি স্তরে বিন্যস্ত করা হয়েছিল। ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভা ছিল সর্বনিম্ন স্তর এবং এর সদস্যদের বলা হতো ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’। ১৯৬৫ সালে পরোক্ষ নির্বাচনব্যবস্থায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আগে নির্বাচিত ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী এ নির্বাচনে নির্বাচকমণ্ডলী হিসেবে কাজ করেন। এ নির্বাচনে বিরোধীদলীয় জোটের প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহকে পরাজিত করে আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

আইয়ুব খানের আবিষ্কৃত মৌলিক গণতন্ত্রব্যবস্থা দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পায়নি এবং আইয়ুব খানের স্বপ্নও সফল হয়নি। ১৯৬৯ সালে গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আইয়ুব খানের পতন হয় এবং তাঁর পতনের মধ্য দিয়ে মৌলিক গণতন্ত্রব্যবস্থার অবসান ঘটে।