চুরি হওয়া মোনালিসা পুনরুদ্ধার

লেওনার্দো দা ভিঞ্চির অমর চিত্রকর্ম মোনালিসা
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

লেওনার্দো দা ভিঞ্চির অমর চিত্রকর্ম মোনালিসা। শত শত বছর ধরে এই চিত্রকর্ম নিয়ে মানুষের চর্চার শেষ নেই। একবার প্যারিসের ল্যুভর জাদুঘর থেকে চিত্রকর্মটি চুরি হয়ে যায়। এর দুই বছর পর ১৯১৩ সালে চিত্রকর্মটি ইতালির ফ্লোরেন্সের একটি হোটেলের কক্ষ থেকে উদ্ধার করা হয়। চুরির আগে থেকে চিত্রকর্মটি বিখ্যাত হলেও চুরি হওয়ার পর সংবাদপত্রের মাধ্যমে শিল্পকর্মটির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। পরিচিতি পায় বিশ্বের অন্যতম আলোচিত ও মূল্যবান শিল্পকর্ম হিসেবে।

গবেষকদের ধারণা, ভিঞ্চি ছবিটি এঁকেছিলেন ১৫০৩ থেকে ১৫০৬ সালের মধ্যে। ১৫১৬ সালে তিনি ইতালি থেকে ফ্রান্সে চলে গেলে ছবিটি সঙ্গে করে নিয়ে যান। ছবিটি উপহার দেন ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিসকে। ভার্সাইয়ের রাজপ্রাসাদে রাখা হয় মোনালিসাকে। এরপর তা চলে যায় নেপোলিয়ন বোনাপার্টের হাতে। নেপোলিয়ন ছবিটি এতই পছন্দ করেন যে তাঁর শোবার ঘরে সাজিয়ে রাখেন। ১৮২১ সালে নেপোলিয়নের মৃত্যুর পর ছবিটি পাঠানো হয় ল্যুভর জাদুঘরে।

চুরি যাওয়ার আগে ল্যুভর জাদুঘরের দেয়ালে মোনালিসা
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

১৯১১ সালের ২১ আগস্ট ল্যুভর জাদুঘর থেকে মোনালিসা চুরি হয়ে যায়। জাদুঘরের কর্মচারী ভিনসেঞ্জো পেরুজ্জিয়া আগের দিন ঝাড়ু রাখার আলমারির ভেতর লুকিয়ে ছিলেন। পরের দিন সকালে ছবিটি কোটের নিচে লুকিয়ে জাদুঘর থেকে বের হয়ে যান। সকালে স্থানীয় একজন চিত্রশিল্পী লক্ষ করেন, দেয়ালে মোনালিসার জায়গাটা ফাঁকা, কেবল চারটি পেরেক চোখে পড়ছে। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারে, চিত্রকর্মটি চুরি গেছে। সেদিন দুপুর থেকেই খবরটি প্রচার হয়ে যায়।

ভিনসেঞ্জো পেরুজ্জিয়া
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

মূল্যবান মোনালিসা খোয়া যাওয়ার ব্যাপারটি মেনে নিতে পারছিলেন না ফরাসিরা। সৃষ্টি হয় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া। বরখাস্ত করা হয় জাদুঘরের কিউরেটর থিওপেলি হোমলোকে। ঘোষণা করা হয়, ছবিটির সন্ধান দিতে পারলে সন্ধানদাতাকে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই ৪০ হাজার ফ্রাঁ দেওয়া হবে।

ইতালির নাগরিক পেরুজ্জিয়া নিজেও ছিলেন চিত্রকর। শিল্পচর্চা করার জন্যই ফ্রান্সে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে জীবিকা নির্বাহ করার জন্য তাঁকে প্যারিসের রাস্তায় খাবার বিক্রি করতে হতো। এরপর চাকরি পান প্যারিসের ল্যুভর জাদুঘরে। সেখানে মোনালিসাকে দেখে তিনি পরিকল্পনা করেন, ইতালীয় শিল্পী ভিঞ্চির চিত্রকর্ম ইতালিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন।

চুরি যাওয়ার পর ফাঁকা দেয়াল
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

তদন্তের সুবিধার জন্য জাদুঘর এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ রাখা হয়। জোসেফ পিয়েরেত নামের এক শিল্পকর্ম চোরের সূত্র ধরে পুলিশ বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো এবং কবি অ্যাপোলিনেয়ারকে সন্দেহ করে বসে! আদালতে তোলা হয় তাঁদের। এর আগে পিয়েরেত কিছু শিল্পকর্ম চুরি করে কবি অ্যাপোলিনেয়ারের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তবে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পুলিশ নিশ্চিত হয় মোনালিসা চুরিতে তাঁদের কেউই জড়িত নন। একসময় তদন্তে ভাটা পড়ে। সবাই ধরে নিয়েছিল ছবিটি আর কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না। এরপর কেটে যায় আরও দুই বছর। ওদিকে শিল্পকর্মটি নিজের বাসায় লুকিয়ে রেখে পেরুজ্জিয়া সীমান্ত পেরিয়ে চলে যান ইতালি।

ইতালি ফিরে গিয়ে পেরুজ্জিয়া একটি বিজ্ঞাপনের সূত্র ধরে শিল্পকর্ম ব্যবসায়ী জেরির কাছে পাঁচ লাখ লিরার বিনিময়ে মোনালিসা বিক্রির প্রস্তাব দেন। জেরি তাঁর বন্ধু ইতালির উফিজি জাদুঘরের কিউরেটর জিওভানি পোজ্জিকে বিষয়টি জানান। পরিকল্পনা অনুযায়ী দুজনে যান ফ্লোরেন্সের ত্রিপোলি-ইতালিয়া হোটেলে। তবে তাঁরা হোটেলে যাওয়ার আগে পুলিশকে জানিয়ে যান।

১৯১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর পেরুজ্জিয়া তাঁর হোটেল কক্ষের খাটের নিচ থেকে বের করেন চিত্রকর্মটি। ছবিটি পরীক্ষার করার কথা বলে জাদুঘরে নিতে চান জেরি ও পোজ্জি। পেরুজ্জিয়া রাজি হন। চিত্রকর্মটি পেরুজ্জিয়ার কাছ থেকে নিরাপদ হতেই পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। আদালতে পেরুজ্জিয়া বলেন, যেহেতু ভিঞ্চি ইতালীয় নাগরিক ছিলেন তাই তিনি চিত্রকর্মটি ইতালিতে নিয়ে এসেছেন। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে এক বছরের জেল হয় তাঁর। দুই সপ্তাহ উফিজির গ্যালারিতে প্রদর্শিত হওয়ার পর সে বছর ৩০ ডিসেম্বর প্যারিসের ল্যুভরে ফিরিয়ে নেওয়া হয় মোনালিসাকে।

পত্রিকার পাতায় মোনালিসা চুরি যাওয়ার খবর
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

ইতালিতে ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে আখ্যা পান পেরুজ্জিয়া। তবে বিশেষজ্ঞরা তাঁর ‘দেশপ্রেম’-তত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন; কারণ, দেশপ্রেমের জন্য এই কাজ করলে তিনি চিত্রকর্মটি কোনো জাদুঘরে দান করে দিতেন, গোপনে বিক্রি করার চেষ্টা করতেন না।

ইতালির উফিজির গ্যালারিতে মোনালিসার বিশেষ প্রদর্শনী
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

যাহোক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পেরুজ্জিয়া যোগ দেন ইতালির সেনাবাহিনীতে। যুদ্ধের পর আবার ফিরে যান ফ্রান্সে। সেখানে একটি রঙের দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন। প্যারিসে ১৯২৫ সালের ৮ অক্টোবর তাঁর ৪৪তম জন্মদিনে মারা যান তিনি।

পত্রিকায় ল্যুভর জাদুঘরে মোনালিসার ফিরে যাওয়ার খবর
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

প্রতিবছর প্রায় ৭০ লাখ লোক ল্যুভর জাদুঘরে যান মোনালিসাকে দেখার জন্য। ল্যুভর জাদুঘরের আলাদা একটি কক্ষে বুলেটরোধী কাচের নিচে রাখা হয়েছে চিত্রকর্মটি। তা ছাড়া চিত্রকর্মটি অক্ষত রাখার জন্য কক্ষটির জলবায়ু বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

ল্যুভর জাদুঘরে মোনালিসাকে দেখার জন্য ভিড়
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস