বলুন তো এই চিঠিতে হুমায়ূন আহমেদের কয়টি বইয়ের নাম আছে

আজ হুমায়ূন আহমেদের দশম মৃত্যুবার্ষিকী। তবে হুমায়ূন–ভক্তমাত্রই এটা বিশ্বাস করেন, তিনি আছেন তাঁর প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যে। তাই প্রিয় লেখকের জন্মদিন কিংবা মৃত্যুবার্ষিকীতে ঘুরেফিরে আসে তাঁর বই, সিনেমা, নাটক কিংবা গানের নাম। চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রাহিমা ফেরদৌসী যেমন হুমায়ূন আহমেদের প্রায় দুই শ বইয়ের নাম দিয়ে লিখেছেন লম্বা একটা চিঠি। এই চিঠির মাধ্যমে আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি গল্পের জাদুকরকে।

হুমায়ূন আহমেদ (১৯৪৮–২০১২)
ছবি: নাসির আলী মামুন, কোলাজ: একটু থামুন

প্রিয় ‘নবনী’,

কেমন আছ? ‘আমি ও আমরা’ সবাই ভালো আছি। ‘এই বসন্তে’ ‘তোমাদের এই নগরে’ এসে ‘তোমাকে’ খুব মনে পড়ছে। ‘একা একা’ ভালো লাগছে না, তাই লিখতে বসলাম।

এবার দেশে এসে পুরোনো স্মৃতিচারণে দিনের ‘প্রথম প্রহর’, ‘মধ্যাহ্ন’, ‘অপরাহ্ন’ পার করে ‘দিনের শেষে’ তোমার মতো ‘একজন মায়াবতী’ ‘মানবী’র ‘অপেক্ষা’য় আছি। আজ তোমাকে ‘আমার ছেলেবেলা’র গল্প বলব।

ময়মনসিংহ জেলার ‘গৌরীপুর জংশন’ ‘ইস্টিশন’ পার হয়ে ‘ময়ূরাক্ষী’ নদীর ধার ঘেঁষে ‘অচিনপুর’ গ্রামে ছিল ‘আমাদের শাদা বাড়ি’। ‘শ্যামল ছায়া’য় ঘেরা সেই বাড়ির নাম ছিল ‘ছায়াবীথি’। ভেতরের ‘দেয়াল’ ছিল হালকা হলদে। ‘দুই দুয়ারী’ সেই বাড়ির সদর দরজায় ‘নীল অপরাজিতা’র গাছে প্রায় সারা বছরই ফুল ফুটত। বাগানের মালি ছিল ‘কুটু মিয়া’, যার হাতে লাগানো হতো ‘মে ফ্লাওয়ার’, ‘জলপদ্ম’। তখন যদি তুমি আমার সঙ্গে সেই বাড়িতে আসতে, তোমার মনে হতো, ‘অন্যভুবন’–এর সেই ‘ছেলেটা’র সঙ্গে অনেক ‘দূরে কোথায়’ চলে এসেছ।

শ্রাবণ মেঘের দিন’–এ ‘আকাশ জোড়া মেঘ’ করলেও ‘মেঘের ছায়া’য় কখনো ‘এই মেঘ, রৌদ্রছায়া’, কখনো বা ‘মেঘ বলেছে যাবো যাবো’, তখন আমরা ‘বৃষ্টি বিলাস’ করতাম। আবহাওয়ার ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’ থাকলেও আমরা কোনো ‘বিপদ’–এর আশঙ্কা করতাম না। মাঝেমধ্যে ‘রজনী’তে দাদাজান, যিনি কিনা সে সময় একজন ‘নৃপতি’ ছিলেন, ‘কালো যাদুকর’কে ডাকতেন। তার যাদুতে আমরা মোহিত হতাম। তার সঙ্গে আসত ‘কুহু রানী’। ‘মন্দ্রসপ্তক’ তালে ‘আশাবরী’ রাগে সে ‘উড়ালপঙ্খি’ গান ধরত। ‘সে ও নর্তকী’ আর ‘রুমালী’ মিলে ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র নাচও দেখাত।

লোকশ্রুতি আছে, দাদাজানের ছোট ভাই একজন ‘অয়োময়’ হলেও তিনি নাকি ছিলেন ‘বৃহন্নলা’।

গ্রামের এই বাড়িটি দিনের বেলায় পাহারা দিত আমার ছোট বোন ‘পারুল ও তার তিনটি কুকুর’। তার কোলে থাকত একটি ‘পুতুল’। সারা বাড়িতে তাদের ছুটে বেড়ানোয় যেন একটা ‘সৌরভ’ ছড়িয়ে থাকত। ও গুনগুনিয়ে গান গাইত, ‘পাখি আমার একলা পাখি’, কখনো বা দিঘির পানিতে পা ডুবিয়ে গাইত ‘আমার আছে জল’। আবার পানিতে উঁকি দিয়ে দেখে বলত, ‘দিঘীর জলে কার ছায়া গো’? তার ‘ছায়াসঙ্গী’ ছিল ‘লীলাবতী’। তাকে আমরা ‘জলকন্যা’ ডাকতাম। দিঘির পানিতে ডুবে ‘লীলাবতীর মৃত্যুর’ পর তার মা ‘পিপলী বেগম’–এর সঙ্গে আমার বোনটিও পাগল হয়ে গেল। সে ভাবত, ‘দরজার ওপাশে’ ‘কে কথা কয়?’। ‘নক্ষত্রের রাতে’ ‘অনন্ত অম্বরে’ যখন ‘অনন্ত নক্ষত্র বীথি’ আলো ছড়াত, তখন সে দিঘিতে ‘জলজোছনা’ দেখত ও বিড়বিড় করে ‘চন্দ্রকথা’র কাহিনি বলত।

আমার ‘দেবী’র মতো দেখতে বোনটির জন্য বাবা বাড়িতে একটা ‘সাজঘর’ বানিয়েছিলেন। চার দেয়াল জুড়ে থাকা সেই ‘আয়নাঘর’ই ছিল তার কল্পনার ‘রূপালি দ্বীপ’। কোনো কোনো দিন চাচাতো বোন ‘তিথির নীল তোয়ালে’ গায়ে জড়িয়ে ওই ঘরে বসে থাকত। তার অসুস্থ হওয়ার পর মা সারাক্ষণই কাঁদতেন আর বলতেন, ‘লিলুয়া বাতাসে’ সব সুখ হারিয়ে গেছে। চারদিকে সব ‘শূন্য’ মনে হতো। আমরা যেন তখন এক ‘শঙ্খনীল কারাগার’–এ বাস করছিলাম। মাথার ভেতর কী ‘পোকা’ যে তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল, তা আমরা বুঝতে পারিনি। এ বিষয়টি ‘মিসির আলীর অমিমাংসিত রহস্য’ই রয়ে গেল।

মনে আছে, ‘১৯৭১’–এর কথা? ৭ মার্চ একজন ‘মহাপুরুষ’ ও ‘কবি’ জনতার মঞ্চে উঠে আবৃত্তি করলেন স্বাধীনতার কবিতা। তাঁর ডাকে যেন জনমনে ‘মাতাল হাওয়া’ বইতে শুরু করল, মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল এ দেশের সূর্যসন্তানেরা। সে বছর ‘চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস’–এ কিছু ‘অমানুষ’ আমার বড় ভাই ‘সম্রাট’ আর তার বন্ধু ‘অনীশ’দাকে ধরে নিয়ে গেল! সঙ্গে গেল ‘চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক’। অমানুষেরা যেন ‘অন্ধকারের গান’ গাইতে গাইতে ভাই ও তার বন্ধুকে চিরদিনের জন্য ‘নির্বাসন’–এ পাঠাল। ওদের আর ‘ফেরা’ হলো না।

এ রকম লাখো প্রাণের বিনিময়ে এক ‘সূর্যের দিন’–এ বাংলার মাটি যেন ‘জনম জনম’ ধরে জ্বলতে থাকা ‘নন্দিত নরকে’র কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীনতা নামের ‘আগুনের পরশমণি’ লাভ করল। দিকে দিকে রচিত হলো আমাদের ‘জয় জয়ন্তী’র কাহিনি। বাঙালির হৃদয়ের ‘এপিটাফ’–এ লেখা হলো তাঁদের নাম।

আজ অনেক বছর পর ‘এইসব দিনরাত্রি’ এখন সংকটমুক্ত। পরাধীনতার ‘নিশিকাব্য’ ছেড়ে সবাই নিজের ‘প্রিয় পদরেখা’ আর কত ‘আনন্দ বেদনার কাব্য’ রচনা করে চলেছি।

আজ রবিবার’, অনেক দিন পর এবার আমার মেজ বোন ‘মীরার গ্রামের বাড়ি’ যাব। শুনেছি, ওর মেয়ে বড় মেয়ে ‘রুপা’ নাকি একটা ছেলেকে পছন্দ করে। কিন্ত মীরা এ সম্পর্কে রাজি নয়। ‘তারা তিনজন’ মিলে আমাকে দাওয়াত দিল। এ বিয়ে হবে আমার ও মীরার ‘দ্বৈরথ’ কাহিনি। তার মেজ মেয়ে ‘ইরিনা’ নাকি আমার কাছে ‘ফিহা সমীকরণ’ শিখবে। ছোট কন্যা ‘নি’র জন্য একটা আজব খেলনা ‘বোতল ভূত’ কিনেছি। তার নাকি খুব ভূতের ‘ভয়’। ভাবছি, মন্ত্র শিখিয়ে দেব—‘ভূত ভূতং ভূতৌ’।

ওহ্ হো, আসল কথাই তো বলিনি, ‘আজ চিত্রার বিয়ে’ (বড় আপার মেয়ে) ‘চৈত্রের দ্বিতীয় প্রহরে’। পাত্রটি কে জানো? বড় আপারই বান্ধবীর বড় ছেলে ‘শুভ্র’। তুমি তো চিত্রাকে দেখোনি, এত রূপবতী! যেন ‘পেন্সিলে আঁকা পরী’। রূপের সঙ্গে কিছুটা পাগলামিও আছে। একবার ‘শুভ্র গেছে বনে’, বেড়াতে গিয়ে তার আর কোনো খোঁজখবর নেই! ফোন করে পাচ্ছে না চিত্রা। সে তো ‘এই শুভ্র! এই’ বলে ডেকেই দিল ছুট! শেষমেশ ঠিকই সে শুভ্রকে খুঁজে বের করল। বিয়ের পর ওরা নাকি ‘দারুচিনি দ্বীপ’–এ ‘সমুদ্রবিলাস’–এ যাবে।

এতক্ষণ তো কেবল আমার কথাই বলে গেলাম। তোমার কথা কিছুই জানা হলো না। তোমার ‘প্রিয়তমেষু’ কেমন আছে? কন্যা ‘মৃন্ময়ী’ ভালো আছে তো? তুমি কি তাদের তোমার ‘জোছনা ও জননীর গল্প’টা শুনিয়েছ?

মনে আছে, ‘যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ’, ‘তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে’? আমি নিয়ে গিয়েছিলাম তোমার জন্য একগুচ্ছ ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’। যেতে যেতে দেরি হয়েছিল বলে তুমি খুব রাগ করেছিলে, আর বলেছিলে, আমার নাকি ‘পায়ের তলায় খড়ম’! আর এখন আমাকে কত দেশের আকাশ ‘পারাপার’ করতে হয়! আজ আমি আমার বাবা-দাদার মতো ‘বহুব্রীহি’ না হলেও ‘কাঠপেন্সিল’, ‘বলপয়েন্ট’ আর ‘ফাউন্টেন পেন’–এর জগতে ‘এই আমি’ একজন স্বঘোষিত ‘বাদশাহ নামদার’। তাই চিরদিন ‘আমার আপন আঁধার’–এ, ‘আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই’।

আমেরিকায় থাকাকালীন একদিন ‘হোটেল গ্রেভারইন’–এ দেখা হলো ‘হিমু’র সঙ্গে। হিমুকে চিনেছো তো? ওই যে আমার খালাতো ভাই। ‘হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম’ দেখে কী যে ভালো লাগল! ওর সঙ্গে তোমার স্বভাবগত মিল খুঁজে পেয়েছি। ‘যশোহা বৃক্ষের দেশে’ থাকলেও মনে–প্রাণে একজন বাঙালি। তোমার কথা বলেছি তাকে। ভালো কথা, এবার কিন্তু দেশে এলাম আমি ‘এবং হিমু’। জোছনা রাত যেন ‘হিমুর রূপালি রাত্রি’। একবার নাকি কোনো এক ‘অরণ্য’ বা বনে ‘হিমু এবং একটি রাশিয়ান পরী’ হারিয়ে গিয়েছিল! পরিটা নাকি ওকে গান শুনিয়েছে ‘হিমুর আছে জল’। সে সময় নাকি ‘হিমুর হাতে পাঁচটি জলপদ্ম’ ছিল। এসব আদতে সত্য নাকি কল্পনা, আমি ঠিক বুঝি না!

এ দেশে আসার পর ‘হিমুর দ্বিতীয় প্রহর’ মানে পরদিন দুপুরে হঠাৎ দেখি, মতিঝিলে ‘হলুদ হিমু কালো র‍্যাব’। উদ্দেশ্যহীন ঘোরাফেরার কারণে তাকে ধরা হয়েছে। এরপর আমি বুঝিয়েসুঝিয়ে বলেকয়ে ছাড়িয়ে নিয়েছি। তাই তার চোখে ‘আমিই মিসির আলি’, সেটা ভেবে আমি মনে মনে হাসি আর ভাবি ‘মিসির আলি UNSOLVED’–ই রয়ে গেল আজীবন। আসলে ‘মিসির আলি’ হওয়া কি চাট্টিখানি ব্যাপার? একদিন তোমাকে ‘হিমুর একান্ত সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য’ কাহিনি শোনাব। এমনকি ‘হিমুর বাবার কথামালা’ও শোনানো যাবে।

আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় না, এ জগত কেবলই এক ‘কুহক’? যা ‘কহেন কবি কালিদাস’? একদিন যখন ‘সবাই গেছে বনে’, তুমি ঘন অন্ধকারে আমাদের বাসায় চলে এলে আমাকে চমকে দেওয়ার জন্য, আর তার পর থেকে আমি তোমাকে ‘নিশীথিনী’ বলে ডাকতাম!

বাদ দিই এসব কথা। চলো, আমরা সবাই মিলে একদিন ‘হরতন ইশকাপন’ খেলব আর ‘দি এক্সরসিস্ট’ সিনেমাটা দেখব। রাতে থাকবে ‘ছোটদের সেরা গল্প’ আর ‘তোমাদের জন্য রূপকথা’। যেখানে সবুজ ‘দ্বীপ’–এ ঘুরে বেড়ায় ‘নীল মানুষ’, ‘নীলহাতী’। অবশ্য এসবে বাচ্চারাই মজা পাবে। বড়দের জন্য থাকবে ‘হুমায়ূন আহমেদের কথামালা’র খেলা, ‘হুমায়ূন আহমেদের শ্রেষ্ঠ গল্প’ ও ‘হুমায়ূন আহমেদের প্রেমের গল্প’। আশা করি, অনেক মজা হবে।

অনেক ‘এলেবেলে’ কথা লিখে ফেললাম। আজ আর নয়, ‘অন্যদিন’ আরও অনেক কথার সঙ্গে ‘শীত ও অন্যান্য গল্প’ লিখব।

তোমাদের জন্য ভালোবাসা’।

ইতি

তোমার শুভাকাঙ্খী

নিষাদ