রানি নেফারতিতির আবক্ষ মূর্তি আবিষ্কার

নেফারতিতির আবক্ষ মূর্তিটি আছে বার্লিনের নিউয়েস মিউজিয়ামে
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

ইতিহাস, ঐতিহ্য আর রহস্যের আরেক নাম প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা। এই সভ্যতার একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি রানি নেফারতিতি। তিনি ছিলেন মিসরের বিখ্যাত ফারাও আখেনাতেনের রাজমহিষী। নেফারতিতির জন্ম আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৭০ অব্দে। তাঁর নামের অর্থ ‘সবচেয়ে সুন্দর মানুষটি এসেছে’। নামের মতোই সুন্দর ছিলেন তিনি। তবে শুধু সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত ছিলেন না; প্রাচীন মিসরের সবচেয়ে রহস্যময়, ক্ষমতাবান ও জনপ্রিয় রানি ছিলেন নেফারতিতি।

রাজপ্রাসাদে বড় হওয়া নেফারতিতির বাবা ছিলেন ফারাও আখেনাতেনের উপদেষ্টা। উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি কিশোর রাজকুমার আখেনাতেনের দেখাশোনা করতেন। শৈশবেই রাজকুমারের সঙ্গে পরিচয় হয় নেফারতিতির এবং অল্প বয়সেই তিনি আখেনাতেনের সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। ১৫ বছর বয়সে রাজকুমারের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর।

ফারাও আখেনাতেনের জীবনে নেফারতিতির প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর। প্রাচীন মিসরের শাসকেরা একাধিক দেব–দেবী বিশ্বাস করলেও আখেনাতেন সূর্যদেবতা ‘আতেন’-এর উপাসনা করতেন। আখেনাতেনের এই ধর্মবিশ্বাসের পেছনে রানি নেফারতিতির প্রভাব ছিল। মন্দিরের পুরোহিতদের পাশ কাটিয়ে আখেনাতেন আতেনের উপাসনা চালু করেন। নেফারতিতির পরামর্শে তিনি নিজের ‘আমেনহোটেপ’ নাম পরিবর্তন করে সূর্যদেবতা ‘আতেন’-এর নামানুসারে রাখেন ‘আখেনাতেন’।

আখেনাতেন ও নেফারতিতি দুজন মিলে প্রাচীন মিসরের সবচেয়ে সমৃদ্ধ সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। আখেনাতেনের রাজত্বে রানি নেফারতিতি একজন ফারাওয়ের মতোই ক্ষমতা ও মর্যাদা ভোগ করতেন। বিভিন্ন স্থানে আখেনাতেনের পাশাপাশি রানি নেফারতিতির ছবিও স্থান পেত। ফারাওদের মমি পাহারা দেওয়ার উদ্দেশ্যে সমাধির চারপাশে চারজন দেবীর ছবি খোদাই করা থাকত। নিজের সমাধিতে চার দেবীর পাশাপাশি নেফারতিতির ছবি খোদাই করে সেই ধারায় পরিবর্তন আনেন আখেনাতেন। সে সময় নির্মিত মন্দিরেও আখেনাতেনের ছবির পাশাপাশি নেফারতিতির ছবি স্থান পেয়েছিল। বিভিন্ন চিত্রকর্মে দেখা যায়, নেফারতিতি যুদ্ধরথে চড়ে অস্ত্র ধরে আছেন, তরবারি হাতে যুদ্ধ করছেন ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের পদক দিচ্ছেন। প্রাচীন মিসরের অন্য কোনো রাজকীয় নারীর ক্ষেত্রে এমন ছবি দেখা যায়নি। আখেনাতেনের সিংহাসনের পাশেই নেফারতিতির জন্য একই আকৃতির সিংহাসন ছিল এবং দুজন একই সঙ্গে রাজসভা পরিচালনা করতেন।

আখেনাতেন ও নেফারতিতির ছিল ছয় কন্যা। আখেনাতেনের অন্য স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নেওয়া তুতেনখামেন পরবর্তী সময়ে ফারাও হন। তুতেনখামেন আবার বিয়ে করেন রানি নেফারতিতির কন্যা আনখেসেনপাতেনকে।

আখেনাতেনের ১৭ বছরের শাসনামলের ১২তম বর্ষে তাঁদের এক কন্যা মারা যায়। সে সময় আঁকা একটা ছবিতে মৃত সন্তানের লাশের পাশে দাঁড়ানো নেফারতিতিকে দেখা যায়। এই ছবির পর যেন ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যান নেফারতিতি। এ ঘটনার কিছুদিন পর আখেনাতেন রাজত্ব পরিচালনার জন্য অন্য এক সঙ্গীর আশ্রয় নেন। ফলে এই ধারণাও করা হয় যে নেফারতিতিকে গুম বা হত্যা করা হয়েছিল। কেউ কেউ ধারণা করেন, তিনি প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, আখেনাতেনের মৃত্যুর পর এবং তুতেনখামেনের অভিষেকের পূর্ববর্তী সময়ে পুরুষের ছদ্মবেশে এবং ‘নেফারনেফারুআতেন’ নামে মিসরের সিংহাসনে বসেন রানি নেফারতিতি। প্রাচীন মিসরের অন্যতম প্রভাবশালী রানি নেফারতিতির সমাধি এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। এর ফলে তাঁর রহস্যময় অন্তর্ধান রহস্যই থেকে গেছে।

১৯১২ সালের ৬ ডিসেম্বর নেফারতিতির একটা আবক্ষ মূর্তি আবিষ্কৃত হলে তিনি পুনরায় আলোচনায় আসেন। মূর্তিটি আনুমানিক ১৩৪৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের। মূর্তিটি আবিষ্কার করে জার্মান প্রত্নতাত্ত্বিক লুদভিগ বোরচার্ডের নেতৃত্বে একটা দল। প্রাচীন মিসরের রাজকীয় ভাস্কর থুটমোসের কর্মশালার মেঝেতে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে চাপা পড়ে ছিল সেটি।

১৯ ইঞ্চি লম্বা ও ২০ কেজি ওজনের আবক্ষ মূর্তিটির বাঁ চোখের মণি পাওয়া যায়নি। বোরচার্ড ধারণা করেছিলেন, থুটমোসের কর্মশালা ধ্বংস হয়ে গেলে চোখের মণিটি হারিয়ে যায়। আবক্ষ মূর্তিটিকে প্রাচীন মিসরের সবচেয়ে বিখ্যাত শিল্পকর্ম হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এর সঙ্গে শুধু তুতেনখামেনের মুখোশের তুলনা চলে। এই মূর্তি নিয়ে প্রায় ১০০ বছর ধরে মিসরের সঙ্গে জার্মানির শীতল যুদ্ধ চলছে। মিসরের দাবি, তাদের পূর্বপুরুষদের বিভ্রান্ত করে মূর্তিটি জার্মানিতে নিয়ে যাওয়া হয়। ‘টাইম’ ম্যাগাজিন মূর্তিটিকে শীর্ষ ১০ লুণ্ঠিত শিল্পকর্মের তালিকায় স্থান দিয়েছে।

বোরচার্ডের দল মিসর সরকারের সঙ্গে একটা চুক্তি করেছিল। সে চুক্তির আলোকে মূর্তিটি জার্মানিতে নেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে জানা যায়, বোরচার্ড মূর্তিটি নিজ দেশে নিতে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন। আবক্ষ মূর্তিটি দেওয়া হয়েছিল অভিযানের অর্থদাতা জ্যাক সাইমনকে। মূর্তিটি তিনি প্রায় এক যুগ নিজের বাড়িতে সাজিয়ে রেখেছিলেন। এর এক বছর পর বার্লিনে মূর্তিটি প্রদর্শন করা হয়। জার্মান একনায়ক হিটলার মূর্তিটি পছন্দ করতেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কখনো রানির মাথা ত্যাগ করব না।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমি এই রানির জন্য নতুন জাদুঘর নির্মাণ করব এবং রানি তাঁর সিংহাসনে বসবেন।’

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জাদুঘরগুলো খালি করা হয় এবং অন্যান্য নিদর্শনের সঙ্গে মূর্তিটি রাখা হয় নিরাপদ স্থানেই। মূর্তিটি প্রথমে একটা বাঙ্কারে এবং পরবর্তীকালে একটা লবণের খনিতে লুকিয়ে রাখা হয়। বিশ্বযুদ্ধ শেষে মার্কিন সেনাবাহিনী মূর্তিটির সন্ধান পেলেও সেটি জার্মানিতেই থাকে।

১৯২৪ সাল থেকে বিভিন্ন সময় মিসর মূর্তিটি প্রত্যাবর্তনের জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য নিদর্শনের বিনিময়ে মূর্তিটি প্রত্যার্পণের প্রস্তাব করলেও তাতে সম্মত হয়নি জার্মানি। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকাকালে মিসর তা ফিরিয়ে দিতে অনুরোধ করে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা প্রত্যাখান করে। ১৯৮৯ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক জার্মানিতে গিয়ে মূর্তিটি দেখেন এবং বলেন, ‘নেফারতিতি বার্লিনে মিসরের সেরা রাষ্ট্রদূত।’ মিসর ২০০৫ সালে ইউনেস্কোকে মূর্তিটি হস্তান্তরে হস্তক্ষেপ করার অনুরোধ করে। মিসরের বিভিন্ন কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও জার্মানি মূর্তিটি ফিরিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানায়।

মূর্তিটি বর্তমানে বার্লিনের নিউয়েস মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। প্রতিবছর প্রায় পাঁচ লাখের বেশি দর্শক মূর্তিটি দেখতে আসেন। জার্মানির পোস্টকার্ড এবং ডাকটিকিটগুলোয় মূর্তিটির ছবি আছে।