কবিরাজের উত্তরাধুনিক কবিতা

আঁকা: জুনায়েদ

আমার মুগ্ধ হওয়ার ক্ষমতা অসাধারণ। এই মুহূর্তে কবিরাজের কথা শুনে মুগ্ধ হচ্ছি। কবিরাজ আমাদের পাড়ার শ্রেষ্ট কবি। জনগণ ভালোবেসে কবিরাজ বলে ডাকে। সুমন হঠাৎ​ কোত্থেকে এসে কবিরাজকে খেপিয়ে দিয়ে বলল, ‘তুমি নাকি ভাই কবিতা-টবিতা কিছু লিখতে পারো না। অন্য কবিদের কবিতার লাইন মারিং-কাটিং করে নিজের বলে চালিয়ে দাও!’

সুমনের কথা শুনে কবিরাজ রেগে গেল, ‘যারা এসব বলে তারা তো জানে না, আমি ফুঁ দিলে এলাকায় কারফিউ জারি হয়! ওসব নিন্দুককে বলে দিস, কবিতা কারও সাফ-কবলা করা দলিল নয়। কবিতার স্থান অনেক ওপরে। কবিতা সর্বজনীন।’

কবিরাজের জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনে সুমন খানিকটা ঘাবড়ে গেল। পরক্ষণে সামলে নিয়ে বলল, ‘ওপাড়ার কবি উজ্জ্বল বলেছেন, তুমি নাকি একদম বটতলার কবি। তোমার কবিতা সভ্যতার আলোকে স্পর্শ করে না। একদম যাচ্ছেতাই, ফালতু!’

কবিরাজ এবার আরও রেগে গেলেন, ‘উজ্জ্বল আবার কবি হলো কবে থেকে! ওটা তো একটা তেলাপোকা! শুধু টিকে আছে। টিকে থাকলে হবে না, আমার মতো মাথা উঁচু করে বাঁচতে হবে। উজ্জ্বলকে বলে দিস, ওকে আমি সভ্যতা থেকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করলাম।’

কবিরাজ তাল হারিয়ে ফেলছে দেখে আমরা সুমনকে চুপ করাই। একটু তেল মেরে বলি, ‘তুমি ছাড়া আধুনিক কবিতা একদম বেসামাল, দাদা। এ দেশের কী সৌভাগ্য, জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে তোমার মতো যুগোত্তীর্ণ কবির জন্ম হয়েছে।’

আমার সুরটা ধরতে পেরে মাখনও তাল মেলায়, ‘আমরা জানি, কবিতা তোমার ধমনীতে প্রবাহিত হয়। তুমি প্রতি নিশ্বাসে কবিতার জন্ম দাও। তবু ধৃষ্টতার সঙ্গে জানতে চাইছি একটি প্রমাণ সাইজের কবিতার জন্ম দিতে তোমার কতক্ষণ সময় লাগে, দাদা?’

মাখনের কথায় কবিরাজ মোহিত হয়ে গেলেন। মাখনের মাথার কোঁকড়া চুলে আলতো হাত বুলিয়ে বললেন, ‘জীবনে যতগুলো বই পড়েছি সেগুলোর প্রচ্ছদ তোর মাথার ওপর তুলে দিলে দশ হাত মাটির নিচে চলে যাবি রে ব্যাটা! টর্নেডো দেখেছিস? আসতে যত সময় লাগে, আমার ততক্ষণও লাগে না কবিতা লিখতে। চোখ বন্ধ করলেই মাথায় দুই-তিন শ লাইনের কবিতা এসে যায়। আমার শেষ কবিতাটা মনে আছে তোদের?’

আমরা সবাই মাথা নাড়ি। পবন দাঁড়িয়ে বলে, ‘আবৃত্তি করছি বিশিষ্ট কবিরাজ অনন্ত মজনুর মাইকেল ফেলপ্‌সকে নিয়ে লেখা কবিতার শেষ কয়েকটি লাইন—

ফেলপ্‌স তুই পাসনে ভয়

হবে হবে হবে জয়

দুর্দিনে আমি সা​িথ হবো তোর

আর তুই পাবি স্বর্ণের ভোর।’

কবিরাজ বেশ সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, ‘কবিতা কেমন লিখলাম, বল।’

কবিতা শুনে আমার কান চিড়বিড় করতে লাগল। হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেলে বিরাট মুশকিল হয়ে যাবে। আমি নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে বলি, ‘জীবনানন্দ দাশের পরে এমন রূপক কবিতা আর কেউ লেখেনি!’

কবিরাজ মৃদু হেসে বললেন, ‘এই কবিতা পড়েই তো মাইকেল ফেলপ্‌স অলিম্পিকে এতগুলো গোল্ড মেডেল জিতে ফেলল!’

কবিরাজের কথা শুনে আমাদের সবার হেঁচকি উঠে গেল। আমরা সবাই তার পায়ের ধুলো নিতে নিতে বললাম, ‘তোমার দাদা জন্ম হওয়া উচিত ছিল কল্লোল যুগে।’

আত্মতৃপ্তিতে কবিরাজের চোখটা বুজে এল যেন। শুকনো মেঘের মতো জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, ‘কালকে রাত ৩টা ৪০ মিনিটে লেখা আমার ৫০০ লাইনের কবিতাটা শুনবি?’

আমরা সবাই একসঙ্গে চিত্কার করে উঠি, ‘শুনব, শুনব।’

‘প্রথম লাইনটা শোন তাহলে।’ কবিরাজ মুচকি হেসে আবৃত্তি করলেন, ‘ঘোড়ায় চড়িয়া রাজা শিকারে বাহির হইলেন...।’

প্রথম লাইন শুনে আমরা সবাই মুগ্ধ হয়ে গেলাম, ‘আহা, কী ব্যঞ্জনা!’

‘এবার শেষ লাইনটা শোন।’ কবিরাজ আবার আবৃত্তি করলেন, ‘ঘোড়ায় চড়িয়া রাজা বনে প্রবেশ করিলেন।’

আমরা সবাই আবার ‘আহা, সাধু, সাধু’ করে কবিরাজকে বললাম, ‘কিন্তু মাঝখানের ৪৯৮ লাইন কোথায় গেল?’

কবিরাজ আমাদের সবাইকে আবারও মুগ্ধ করে দিয়ে জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, ‘রাজার শিকারে বের হওয়া আর বনে প্রবেশ করার মাঝখানের ৪৯৮ লাইন হলো শুধু “টগবগ টগবগ টগবগ”!’