‘গরিবের বউ হগ্গলের ভাবি, কথাটার মানে কী ভাবি?’—এই প্রশ্ন একবার এক গরিবের বউকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।
জবাবে ভাবি যা বলেছিলেন, তার চুম্বক কথা হলো, গরিবের দরজায় তালাচাবি তো থাকেই না, অনেক সময় দরজাও থাকে না। যার যখন মনে চায়, সে তখন ভাবাভাবি ছাড়াই নবাবি কায়দায় ‘ও ভাবি ঘরে আছ নাকি? দেশলাইডা দ্যাও দিকিন, বিড়িডা ধরাব’ বলতে বলতে ঘরে ঢুকে পড়ে। কেউ হয়তো হাঁক ছেড়ে দাবি ছুড়ে দেবে, ‘ও ভাবি, এক গেলাস পানি দেও দিনি!’ তারপর ভাবির হাত থেকে পানির গ্লাস নিতে নিতে ঘরের মধ্যে থাকা থালাবাটি-কাঁথাবালিশে চোখ বুলাবে। তারপর হয়তো গরিবের বউকে জিজ্ঞেস করবে, ‘দ্যাশের বাড়ি কই? ভাই কাজকাম কী করে? বিয়ে হইছে কদ্দিন? বাচ্চাকাচ্চা নিচ্ছ না ক্যান?’ গরিবের বউ ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক; বুঝে হোক, না বুঝে হোক; নিজের বাড়ি, বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ির হাঁড়ির-নাড়ির সব খবর দিয়ে দেন।
মানে, গরিবের বউ সমাজের লোয়ার লেভেলের তলে তালাচাবিহীন যে ঘরে বাস করেন, সেখানে প্রাইমারি পর্যায়ের প্রাইভেসিও থাকে না। ব্যক্তিগত আড়াল–আবডাল থাকে না। এই কারণে এমনি এমনিই গরিবের বউয়ের ঘরের কথা পরে জানতে পারে। তাঁর চাল-ডাল-হাঁড়ি-নাড়ি-ওষুধ-পথ্যের সব তথ্য থাকে ‘উদলা’। তাঁর ফাঁস হওয়ার মতো সত্য তথ্য বলতে কিছু থাকে না। আমরা ভাবেসাবে যতই নবাবি চালে চলি, আসলে আমরা সবাই অভাবি ‘গরিবের বউ’। আমরা প্রায়ই প্রাইভেসি নিয়ে কথা বলি; কিন্তু আদতে আমাদের আবডাল নেই। সরকারি ওয়েবসাইটের ‘ভাঙা ঘরের ভাঙা চালা, ভাঙা বেড়ার ফাঁক’ দিয়ে আমাদের নিজেদের নাম, বাপ–দাদার নাম, ভোটার আইডির নম্বর, পাসপোর্টের নম্বর, জমিজমার তথ্য—সব এখন দেখা যাচ্ছে। ব্যক্তির তথ্য ‘গত’ হয়েছে। ইন্টারনেটের উদলা মাঠে কোটি কোটি লোকের গোপনীয় তথ্য বাতাস খাচ্ছে।
হাতের তথ্য যাতে বেহাত না হয়, সে জন্য ‘সার্ট’ নামে আমাদের সাইবার দারোয়ানদের একটা দল আছে। কিন্তু তারা টেরও পায়নি, একটি সংস্থার ওয়েবসাইটে থাকা কয়েক কোটি লোকের তথ্য উন্মুক্ত হয়ে আছে। সেখান থেকে তথ্য নিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এসব যে ঘটে যাচ্ছে, তা খাইবার তালে থাকা সাইবার দারোয়ানেরা টের তো পানইনি; তাঁদের সজাগ করতে এই খবর দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার এক লোক যে ই–মেইল করেছিলেন, তা–ও তাঁরা খুলে দেখেননি। ফলে সাইবার নিরাপত্তায় ঢালা সব অর্থ জলে গেছে। তলে তলে কোটি পাঁচেক লোকের হাঁড়ি-নাড়ি-ওষুধ-পথ্যের সব তথ্য বেহাত হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রধান বলেছেন, ‘তথ্য চুরিও হয়নি, হ্যাকিংও হয়নি। কিছু তথ্য শুধু দেখা যাচ্ছে।’ তাঁর কথায় আবারও নিজেদের ‘গরিবের বউ’য়ের মতো উদার মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমাদের তথ্য নিয়ে অত ঢাকাঢাকির কিছু নেই। আমাদের তথ্য নিয়ে কারও যদি কোনো উপকার হয়, হোক না! এই কারণে আমাদের তথ্য চুরিও করতে হয় না, হ্যাকিংও করতে হয় না। যে–কেউ এসে এমনি এমনি ‘দেখে’ যেতে পারে। ভাবছি ওই ওয়েবসাইটের মাস্টহেডে স্লোগানটি দিলে কেমন হয়: ‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়।’