মার্কিন মুলুকে ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’ চালু

আমেরিকান চিত্রশিল্পী জেনি অগাস্টা ব্রাউনসকম্বের আঁকা ‘দ্য ফার্স্ট থ্যাংকসগিভিং অ্যাট প্লাইমাউথ’, ১৯১৪
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

যুক্তরাষ্ট্রে বড়দিনের পর সবচেয়ে বড় উৎসব থ্যাংকস গিভিং ডে। এই দিনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রবাসীর থাকে অনেক পরিকল্পনা। সরকারি ছুটির দিনটিতে দেশজুড়ে থাকে নানা আয়োজন। থ্যাংকস গিভিং ডে ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন। তবে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার বাইরে দিনটি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সংস্কৃতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই দিনে পরিবার, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব সবাইকে নিয়ে জীবনের প্রতিটা সাফল্যের জন্য এবং দেশ ও জাতির সাফল্যের জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানানো হয়।

থ্যাংকস গিভিং ডে উদ্‌যাপনের ভিত রচিত হয়েছিল আজ থেকে চার শতক আগে। ১৬২০ সালের সেপ্টেম্বরে ইংল্যান্ডের সাদাম্পটন থেকে ‘মে ফ্লাওয়ার’ নামের একটা জাহাজে চেপে কিছু তীর্থযাত্রী ইংল্যান্ড ছেড়ে রওনা হন নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে। ইংল্যান্ডে তখন ধর্মচর্চায় কিছু বিধিনিষেধ ছিল। ফলে স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চা ও ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তাঁরা অজানা গন্তব্যে যাত্রা করেন। উইলিয়াম ব্র্যাডফোর্ডের নেতৃত্বে ওই অভিযানে যোগ দেন আরও ১০২ জন তীর্থযাত্রী। প্রায় ১০০ দিনের দুর্বিষহ যাত্রার পর জাহাজটি আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে তাঁরা গড়ে তোলেন প্লাইমাউথ নামের একটা গ্রাম। শুরু হয় মুক্তভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। এই ধর্ম প্রচারক দলের জন্য প্রথম শীতকালটি ছিল ভয়াবহ। শীত শেষে বসন্ত শুরু হওয়ার আগেই দলের প্রায় অর্ধেক সদস্য মারাত্মক খাদ্যসংকট ও নানা রকম ছোঁয়াচে রোগের কারণে মারা যান। স্থানীয় আদিবাসী গোষ্ঠীর এক সদস্য তাঁদের দেখতে পান। কদিন পর তিনি ফিরে আসেন স্কোয়ান্তো নামের আরেকজনকে সঙ্গে নিয়ে। স্কোয়ান্তোকে আগে দাস হিসেবে ইংল্যান্ডে বিক্রি করা হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে সেখান থেকে পালিয়ে আসেন তিনি। মে ফ্লাওয়ারের যাত্রীদের দুরবস্থা দেখে সহানুভূতি জাগে তাঁর মধ্যে। তীর্থযাত্রীদের শিখিয়ে দেন চাষাবাদ, মাছ ধরা ও ম্যাপল গাছ থেকে রস সংগ্রহের কৌশল।

১৬২১ সালের নভেম্বরে নতুন তীর্থযাত্রীরা প্রথমবারের মতো নিজেদের উৎপাদিত ফসল ঘরে তোলেন। তাঁদের উৎপাদিত ভুট্টার ফলন এত ভালো হয়েছিল যে পরবর্তী শীত পর্যন্ত তাঁদের কোনো খাদ্য ঘাটতি হয়নি। মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া উইলিয়াম ব্র্যাডফোর্ড ও তাঁর দলের সদস্যরা ফসলের এমন প্রাচুর্যকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ হিসেবে মেনে নেন। তাঁরা ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তিন দিনব্যাপী উৎসব উদ্‌যাপন করেন। এই উৎসবে আমেরিকার আদি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ইংল্যান্ড থেকে আগত তীর্থযাত্রীদের মধ্যে উৎপাদিত শস্য ও পণ্য বিনিময় চলে। তখন উৎসবটিকে থ্যাংকস গিভিং ডে নামকরণ করা না হলেও সেটাই ছিল থ্যাংকস গিভিং ডে উদ্‌যাপনের ভিত্তি। তীর্থযাত্রীদের দেখাদেখি অন্যরাও ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের উৎসব পালন করতে শুরু করে। তবে বছরের কোনো নির্দিষ্ট দিনে তা পালিত হতো না। প্রতি বছর নিয়মিতভাবেও পালিত হতো না উৎসবটি।

বহু বছর পর ইংল্যান্ডের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর নতুন মাত্রা পায় থ্যাংকস গিভিং ডে। ১৭৮৯ সালের ২৬ নভেম্বর জর্জ ওয়াশিংটন মার্কিন জনগণকে স্বাধীনতার জন্য ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে থ্যাংকস গিভিং ডে পালনের আহ্বান জানান। এরপর ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে উৎসবটি। ১৮১৭ সালে প্রথমবারের মতো নিউইয়র্কে ছুটির দিন হিসেবে উৎসবটি পালিত হয়। তবে একেক রাজ্যে উৎসবটি উদ্‌যাপিত হতো একেক দিনে।

আমেরিকার গৃহযুদ্ধ চলাকালে ১৮৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন নভেম্বর মাসের শেষ বৃহস্পতিবার থ্যাংস গিভিং ডে পালনের কথা ঘোষণা করেন। প্রেসিডেন্টের ঘোষণার পেছনে সারাহ জোসেফা নামের একজন লেখকের নিরন্তর প্রচেষ্টা ছিল। সরকারিভাবে থ্যাংকস গিভিং ডে পালনের দাবিতে তিনি দীর্ঘ ৩৬ বছর ধরে সম্পাদকীয় এবং প্রবন্ধ লেখেন। বিভিন্নভাবে জনমত সংগ্রহ করার পাশাপাশি তিনি প্রেসিডেন্ট এবং বিভিন্ন রাজ্যের গভর্নর ও সিনেটরদের কাছে চিঠি লিখে দিবসটি পালনের দাবি জানান। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ মন্দার কারণে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট থ্যাংকস গিভিং ডে পালনে পরিবর্তন আনেন। ফলে ১৯৪১ সাল থেকে নভেম্বর মাসের শেষ বৃহস্পতিবারের পরিবর্তে চতুর্থ বৃহস্পতিবার দিবসটি পালিত হতে থাকে।

থ্যাংকস গিভিং ডে উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে থাকে টার্কিভোজ। ধনী-গরিব সবাই মেতে ওঠে ঐতিহ্যবাহী টার্কিভোজে। তাছাড়া খাবার হিসেবে আরও থাকে ক্র্যানবেরি সস, ম্যাশড পটেটো, স্টাফিং ও ঐতিহ্যবাহী পাম্পকিন পাই। এই দিনে সরকারিভাবে প্যারেডের আয়োজন করা হয়। প্যারেডে তীর্থযাত্রী ও আদি আমেরিকানদের প্রদর্শনী থাকে। টিভি চ্যানেলেগুলোয় প্রচার হয় বিশেষ অনুষ্ঠান। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঘোষণা করে আকর্ষণীয় অফার।