স্বৈরশাসক নরিয়েগাকে উৎখাতের লক্ষ্যে পানামায় মার্কিন হামলা শুরু

পানামার জাপাতিলা দ্বীপ
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

পানামা উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের সংযোগস্থলে অবস্থিত একটি স্বাধীন দেশ। পাহাড় ও সমুদ্রে ঘেরা দেশটিতে আছে এক বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি শত শত প্রজাতির পাখি এবং গাছের জন্য বিখ্যাত পানামা। এর পশ্চিমে কোস্টারিকা, দক্ষিণ-পূর্বে কলম্বিয়া, উত্তরে ক্যারিবীয় সাগর ও দক্ষিণে প্রশান্ত মহাসাগর। আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে সংযোগকারী পানামা খালের জন্য ভৌগোলিকভাবে দেশটির অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। মিসরের সুয়েজ খালের পর এটি পৃথিবীর দীর্ঘতম কৃত্রিম খাল।

১৫০১ সালে রদ্রিগো গালভান দে বাস্তিদাস নামের একজন স্প্যানিশ অভিযাত্রী প্রথম পানামায় অবতরণ করেন। এরপর ১৫১০ সালে পানামায় স্প্যানিশ বসতি তৈরি হয় এবং ১৫১৯ সালে স্প্যানিশদের হাতে পানামা সিটির পত্তন। স্প্যানিশদের বয়ে নিয়ে যাওয়া বিভিন্ন রোগব্যাধির বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ না থাকায় পানামার আদিবাসীদের অনেকে মৃত্যুবরণ করে। আর বেঁচে যাওয়া আদিবাসীদের নিয়ে স্প্যানিশরা একধরনের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করে, যেখানে আদিবাসীরা প্রজা হিসেবে বসবাস করত।

পানামা খালে জাহাজ
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

পানামা ১৮২১ সালে স্পেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এর আগে ১৮১৯ সালে ইকুয়েডর, পেরু, বলিভিয়া, ভেনেজুয়েলাসহ এই অঞ্চলের স্পেনীয় উপনিবেশ দেশগুলো মিলে ‘গ্র্যান কলম্বিয়া’ নামের একটি প্রজাতন্ত্র গঠন করে। ১৮৩১ সালে গ্র্যান কলম্বিয়া ভেঙে গেলে পানামা কলম্বিয়ায় যোগ দেয়। ১৮৯৯ থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত কলম্বিয়ার সঙ্গে পানামার যুদ্ধ চলে। এই গৃহযুদ্ধ ‘হাজার দিনের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ১৯০৩ সালে পানামা কলম্বিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।

১৮৪৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র পানামাজুড়ে রেলপথ নির্মাণের চুক্তি করে। এরপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট পানামার মধ্য দিয়ে আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরকে সংযোগকারী একটি খাল খনন করার পরিকল্পনা করেন। বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে ১৯০৪ সালে খাল খননের কাজ শুরু হয়। শ্রমিকদের অনেকেই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তা সত্ত্বেও ১৯১৪ সালে খাল খনন সম্পন্ন হয় এবং প্রথম জাহাজটি পানামা খাল দিয়ে যাত্রা করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ১৯২০ সালে খালটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। চুক্তি অনুযায়ী মার্কিন সেনাবাহিনী ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত পানামা খালের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল।

মার্কিন বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের পর ম্যানুয়েল আন্তনিও নরিয়েগা
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

১৯৭০ সালের দিকে পানামার সামরিক কর্মকর্তা ম্যানুয়েল আন্তনিও নরিয়েগাকে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর পক্ষে মধ্য আমেরিকায় সমাজতন্ত্র বিস্তারের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য নিয়োগ করা হয়। ১৯৮৪ সালে ম্যানুয়েল নরিয়েগা পানামার প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন। ক্ষমতায় এসে তিনি একটি দমনমূলক শাসনব্যবস্থা চালু করেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কিন্তু নিকারাগুয়ায় সান্দিনিস্তা সরকারকে উৎখাত করার প্রচেষ্টায় অংশ নেওয়ায় মার্কিন সরকার আরও কিছুদিন নরিয়েগাকে সমর্থন দিয়ে যায়। তখনকার সবচেয়ে চমকপ্রদ খবর ছিল, নরিয়েগা সিআইএর পাশাপাশি কিউবার গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট হিসেবেও কাজ করেছিলেন। সম্পর্কের আরও অবনতি হলে ১৯৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র পানামার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেয়। ১৯৮৮ সালে মার্কিন ফেডারেল আদালতে নরিয়েগার বিরুদ্ধে মাদক চোরাচালান ও অর্থ পাচারের অভিযোগ আনে। ১৯৮৯ সালের ৭ মে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত হলে নরিয়েগা নির্বাচনের ফল বাতিল করেন।

পানামা খালের নিরাপত্তায় নিয়োজিত মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে নরিয়েগার অনুগত পানামার প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ পানামা খাল অঞ্চলে অতিরিক্ত সেনা পাঠানোর নির্দেশ দেন। পানামা খাল অঞ্চলে ১৬ ডিসেম্বর একজন অফ ডিউটি মার্কিন মেরিন সেনাকে গুলি করে হত্যা করা হলে প্রেসিডেন্ট বুশ পানামায় মার্কিন আক্রমণের অনুমোদন দেন। নরিয়েগাকে উৎখাত করার জন্য পরিচালিত এই হামলাকে ‘অপারেশন জাস্ট কজ’ নামে অভিহিত করা হয়। ১৯৮৯ সালের ২০ ডিসেম্বর হামলা শুরু হয় এবং অল্প কয়েক দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র নরিয়েগা সরকারকে উৎখাত করে। নরিয়েগা ভ্যাটিকান দূতাবাসে আশ্রয় নেন এবং ১৯৯০ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি আত্মসমর্পণ করেন। এই হামলায় ২৩ জন মার্কিন সেনা ও ৩ জন মার্কিন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। অন্যদিকে নিহত হন পানামা প্রতিরক্ষা বাহিনীর ১৫০ জন সেনা ও প্রায় ৫০০ বেসামরিক ব্যক্তি। ১৯৮৯ সালের ৭ মের নির্বাচনে জয়ী গুইলারমো এন্ডারাকে প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পানামায় বেসামরিক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে।

১৯৯২ সালে মার্কিন ফেডারেল আদালতে নরিয়েগার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে মাদক পাচারসহ মোট আটটি অভিযোগ আনা হয়। মাদক পাচারের অভিযোগের পাশাপাশি অর্থ পাচার, পানামায় গণতন্ত্র দমন ও মার্কিন নাগরিকদের বিপন্ন করার অভিযোগও আনা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মার্কিন ফেডারেল আদালত একজন বিদেশি নেতাকে অপরাধমূলক অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেন। বিচারে তাঁকে ৪০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পানামায় প্রত্যর্পণের পর ২০১৭ সালের ২৯ মে পানামা সিটির একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান।

১৯৭৭ সালে সম্পাদিত একটি চুক্তি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর খালটির মালিকানা পানামার কাছে হস্তান্তর করে। ফলে পানামায় অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচনা হয়।