বসন্ত এসে গেছে ঠিকই, তবে...

আঁকা: সাদমান মুন্তাসির

রাইসা বলল, ‘আমি শাড়ি পরে আসব, তুমি?’

ফাস্টফুডের দোকানে এসি চলছে। এসির আরামে আমার ঘুম চলে আসছে। ঝিমুনির মধ্যেই বললাম, ‘অ্যাঁ?’

: আরে, কী পরবা তুমি?

: কী পরব?

: কালকে পয়লা ফাগুন না! বসন্ত বসন্ত…পরবা না কিছু স্পেশাল?

: হুম।

: কী হুম? একটা পাঞ্জাবি পরবা, বুঝতে পেরেছ?

: আচ্ছা।

: হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পরবা কিন্তু।

: ঠিক আছে।

রাইসা হেসে চলে গেল। কিন্তু বিপদে ফেলে গেল আমাকে। আমার কোনো হলুদ পাঞ্জাবি নেই। রাতুলের আছে। দিলাম রাতুলের মেসে হানা।

: তোর না একটা হলুদ পাঞ্জাবি ছিল?

: কী বলিস, কবে?

: কবে মানে? তোর না এক্স জিএফ গিফট করছিল লাস্ট বসন্তে!

: কে, মিলা?

: হ্যাঁ হ্যাঁ, মিলা। তোর ওই জিএফ হিমুর হেবি ফ্যান ছিল, তোকে একটা পকেট ছাড়া হলুদ পাঞ্জাবি দিছিল না?

: তাই তো দোস্ত! কিন্তু পাঞ্জাবিটা কই? আমি তো এইখানেই রাখছিলাম!

‘এইখানে’ বলতে রাতুল যেটা দেখাল সেটা দেয়াল ধরে কাপড়ের ভারে কোনোমতে দাঁড়িয়ে থাকা আধভাঙা একটা আলনা। তাতে রাজ্যের কাপড় স্তূপ হয়ে কেওক্রাডং হয়ে আছে। আমরা কেওক্রাডং বিজয়ের আশায় তিন ঘণ্টা খাটলাম। তাতে অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস বেরিয়ে এল—দুটি নতুন কিন্তু ধুলামাখা ফুলহাতা শার্ট, তিনটা অব্যবহৃত স্যান্ডো গেঞ্জি আর একটা টাই। টাইটা পেয়ে রাতুল আবেগে অস্থির হয়ে পড়ল। প্রথম চাকরির ইন্টারভিউয়ে যাওয়ার জন্য নাকি রাতুলের এক্সেরও আগের এক্স রুনা টাইটা তাকে গিফট করেছিল। কিন্তু সময়মতো খুঁজে না পাওয়ায় সেটা পরা হয়নি। আর সে কারণেই নাকি রুনার সঙ্গে ব্রেকআপ হয়েছিল। টাইটা হাতে নিয়েই রাতুল ফোন দিল কাউকে। বলল, ‘রুনা, বাবু, আমি না তোমার সেই টাইটা খুঁজে পেয়েছি। চলো না বাবু, কালকে বসন্তে দেখা করি!’

ওদিক থেকে রুনা কী বলল কে জানে, রাতুল ‘ইয়াহু’ বলে লাফ দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘থ্যাঙ্কস বন্ধু, থ্যাঙ্কস! পয়লা ফাগুনে আমাকে আর সিঙ্গেল থাকতে হবে না!’

রাতুলের আনন্দ দেখে খুশি হওয়ার বদলে আমার ভীষণ মেজাজ খারাপ হলো। বললাম, ‘কোথায় কোথায় তুই জামাকাপড় রাখিস, জানিস না? তোর হলুদ পাঞ্জাবিটা না পেলে রাইসার সাথে দেখা করতে যেতে পারব না! বুঝতে পারছিস?’

: দোস্ত, কোনো চিন্তা করিস না! তোর জন্য আমার ভাঙা প্রেম জোড়া লাগতে যাচ্ছে, আর তুই একটা হলুদ পাঞ্জাবির জন্য টেনশনে থাকবি? তোকে আজকেই আমি হলুদ পাঞ্জাবি গিফট করব। চল!

ঢাকা শহরে মানুষ ও মার্কেটের অভাব নেই। হাতের কাছে যে মার্কেট পেলাম তাতেই ঢুকে গেলাম। কিন্তু কোথাও হলুদ পাঞ্জাবি নেই। পরের মার্কেট—হলুদ পাঞ্জাবি—নেই। তার পরেরটাতেও নেই। পাঁচ ঘণ্টা চষে বেরিয়ে আমাদের চেহারা হলুদ হয়ে গেল, কিন্তু হলুদ পাঞ্জাবি আর পাওয়া গেল না। দোকানিদের এককথা, ‘গতকালকেও ছিল, কিন্তু সব শেষ। বসন্ত বলে সবাই হলুদ পাঞ্জাবি ডাবল দামে কিনে নিয়ে গেছে।’

হঠাৎ রাইসা ইনবক্সে নক করল। তাতে হলুদ শাড়ির দুটি ছবি। ও লিখেছে, ‘বলো তো কোনটা পরব?’ আমি লিখলাম, ‘পার্থক্য কী? দুইটাই তো হলুদ!’

: দুইটা হলুদ মানে? দেখতে পাচ্ছ না, একটা রানি হলুদ আরেকটা…

: আরেকটা রাজা হলুদ?

: থাক! তোমাকে আর বলতে হবে না! শোনো, তোমার পাঞ্জাবির ছবি পাঠাও, ওটার সাথে যে শাড়িটা বেশি ম্যাচ করবে সেটা পরব, ঠিক আছে?

আমার মাথার চুল খাড়া হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি লিখলাম, ‘আরে আরে, শোনো না! আমি তো এখনো বাইরে। আর পাঞ্জাবি তো বাসায়। বাসায় গিয়ে পাঠাই?’

: অবশ্যই পাঠাবে কিন্তু। তোমার পাঞ্জাবি দেখে আমার শাড়ি ঠিক করব। তারপর সেই শাড়ি বুঝে ব্লাউজ, টিপ, নেইলপলিশ, স্যান্ডেল, চুড়ি, আইশ্যাডো সব ঠিক করব! বুঝেছ?

আমি রাতুলের দিকে তাকালাম। রাতুল বলল, ‘দোস্ত, আইডিয়া!’

: কী?

: ফটোশপ!

: মানে?

রাতুল গুগলে সার্চ দিয়ে খুঁজে খুঁজে বের করল হলুদ পাঞ্জাবির ছবি। সেই ছবিটা কেটে আমার ঘরের বিছানার ছবির ওপর সেঁটে দিলো। বলল, ‘কী? বোঝা যাচ্ছে কিছু?’

আমি সঙ্গে সঙ্গে ছবিটা পাঠিয়ে দিলাম রাইসাকে। ওদিক থেকে এল লাভের ইমোটিকন। তারপর নীরবতা। বুঝলাম, রাইসা ঝঁাপিয়ে পড়েছে তার ম্যাচিং নিয়ে। কিন্তু আমার কী হবে? হলুদ পাঞ্জাবি ছাড়া কালকে রাইসাকে মুখ দেখাব কী করে?

এবারও উদ্ধারকর্তা রাতুল। বলল, ‘তোর সাদা পাঞ্জাবি আছে না?’

: আছে।

: ব্যস! তাইলে তো হয়েই গেছে!

: কী?

: চল রং কিনি!

রং কিনে আমরা যখন বাসায় ফিরলাম তখন রাত বারোটার মতো বাজে। ফেসবুকে বসন্ত নিয়ে হাউকাউ শুরু হয়ে গেছে। অথচ আমাদের চলছে রং নিয়ে ভংচং। মেঝেতে সাদা পাঞ্জাবির ওপর করে চলেছি হলুদ রং। সেই রং লাগছে আমাদের শরীরেও। আর রংগুলো উঠছে না দেখে খুব খুশি রাতুল। বলছে খুব পাকা রং, ওঠার কোনো চান্স নাই! বৃষ্টি হলেও নাই!

: বসন্তে বৃষ্টি হবে ক্যান?

: আবহাওয়ার কোনো গ্যারান্টি আছে? ওয়েদার এখন মেন্টাল কেস! দেখ না কী সুন্দর হয়েছে তোর হলুদ পাঞ্জাবি!

আমি তাকিয়ে দেখলাম। আসলেই খুব খারাপ হয়নি। পাঞ্জাবি শুকাতে দিয়ে ঘুমাতে গেলাম। ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখলাম, আমি আর রাইসা দুজনে পয়লা ফাগুনে হাত ধরাধরি করে হাঁটছি। রাইসার পরনে হলুদ পাঞ্জাবি আর আমার পরনে হলুদ শাড়ি। হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি, রাইসার পাঞ্জাবি থেকে গলগল করে রং উঠে যাচ্ছে। রাইসা চিৎকার করে বলছে, ‘ফ্রড! তুমি একটা ফ্রড!’

ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠলাম আমি। ভীষণ মাথাব্যথা। চোখেও মনে হচ্ছে ঝাপসা দেখছি। ব্রাশ করতে গিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে আঁতকে উঠলাম। চোখ আগুনের মতো লাল। আর মুখভর্তি ঘামাচি। এত ঘামাচি কোনোকালে আমার উঠেছিল কি না সন্দেহ! পরক্ষণেই বুঝলাম, এগুলো ঘামাচি না, বসন্ত! গুটিবসন্ত। ওদিকে রাইসার ফোন, ‘হ্যালো, শুভ বসন্ত, হীরক!’

আমি বললাম, ‘শুভ গুটি বসন্ত, রাইসা!’