মাখন কেন পাহাড়ে যায়?

আঁকা: জুনায়েদ

মাখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে এখন চাকরি করছে। চাকরির পাশাপাশি সে তার চুল, দাড়ি, গোঁফ লম্বা করে এবং মাঝেমধ্যে বান্দরবান আসা-যাওয়া করে। মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে চুল, দাড়ি লম্বা করে সাধু-সন্ত হয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে! মাখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পড়ালেখার চাপে কখনো প্রেম করেনি; ফলে ছ্যাঁকা খাওয়ার সুযোগও কখনো হয়ে ওঠেনি তার।

মাখনের সঙ্গে আমার মাঝেমধ্যে রাস্তায় দেখা হয়। যখনই দেখা হয় তখনই সে বান্দরবান যাচ্ছে, না হয় বান্দরবান থেকে ফেরত আসছে। দেখা হলেই তাড়াহুড়ো করে বলে, ‘দোস্ত, দোয়া করিস।’

আমি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘সব ঠিক আছে তো?’

মাখন তার চুল, দাড়ি কাঁপিয়ে রহস্যময় হাসি হাসে।

একদিন মাখনকে চেপে ধরলাম, ‘তুই এত ঘন ঘন বান্দরবান যাস কেন? ওখানে কী আছে?’

মাখন মন খারাপ করে বলল, ‘দোস্ত, এই জীবন লইয়া কী করিব? এই জীবন লইয়া কী করিতে হয়?’

আমি হকচকিয়ে গেলাম, ‘এ রকম বইয়ের ভাষায় কথা বলছিস কেন?’

মাখন চোখ-মুখ কালো করে বলল, ‘যখনই আমার কোনো বন্ধুর বিয়ে হয়, আমি মনের দুঃখে বান্দরবান চলে যাই। বান্দরবান গিয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরি।’

আমি ভেবে দেখলাম, ঘটনা সত্যি। আমাদের কোনো বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠান হলেই মাখন বান্দরবান যাওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করে। আমি প্রবল আগ্রহে মাখনকে আরও বেশি চেপে ধরি, ‘বন্ধুর বিয়ের সাথে পাহাড়ে যাওয়ার সম্পর্ক কী?’

আমার আর কথা বাড়ানোর সাহস হলো না। আজকে রক্ত চাইছে, কালকে কিডনি জোড়া চেয়ে বসতে পারে। আমি মাখনের কাছ থেকে সরে আসি।

মাখন দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলে, ‘আমার যে বিয়ের বয়স হয়েছে, এটা বাপ-মাকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাঁরা বুঝেও বুঝতে চান না। তাই মনের দুঃখে পাহাড়ে চলে যাই। প্রত্যেকবার ভাবি, এবার ফিরে এলেই ঘরে আটকে রাখতে বাবা-মা নিশ্চয় আমার বিয়ের কথা ভাববেন। কিন্তু একটা ঘটনার পর সেই আশাটাও একদম ছেড়ে দিয়েছি।’

আমার খুব কৌতূহল হয়, ‘কী ঘটনা ঘটেছিল?’

মাখন বলে, ‘গত বর্ষায় এক বন্ধুর বিয়ে হচ্ছিল। আমি মনের দুঃখে বান্দরবান যাওয়ার আগে বাবাকে সালাম করে বললাম, “দোয়া কোরো বাবা, ঠিকমতো যেন পাহাড়ে উঠতে পারি।” বাবা দোয়া করে দিয়ে বললেন, “হাঁটুসমান লম্বা প্লাস্টিকের কিছু জুতা পাওয়া যায়। যাওয়ার সময় ওগুলো এক জোড়া কিনে নিয়ে যাস। বর্ষাকালে পাহাড়ে প্রচুর জোঁক বের হয়।”’

মাখনের মতো আমারও মন খারাপ হয়, ‘তুই কি সেই বুটজুতা কিনে নিয়েছিলি?’

মাখন বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘কিনেছিলাম। কিন্তু অভাগা যেদিকে চায়, সেদিকে বঙ্গোপসাগরও শুকিয়ে যায়। সেই বুটজুতা ভেদ করে তিনটা জোঁক ঢুকে আমার সব রক্ত চুষে খেয়ে ফেলেছে। এখন আমি রক্তশূন্যতায় ভুগছি। তোর সাথে ম্যাচ করলে তুই আমাকে এক ব্যাগ রক্ত দিয়ে যাস।’

আমার আর কথা বাড়ানোর সাহস হলো না। আজকে রক্ত চাইছে, কালকে কিডনি জোড়া চেয়ে বসতে পারে। আমি মাখনের কাছ থেকে সরে আসি।

মাখনের সঙ্গে আর খুব বেশি দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। লোকমুখে শুনেছি, মাখন পর্বতারোহণে এখন এত বেশি পারদর্শী হয়েছে যে সে নিজেই পর্বতারোহণের একটি ক্লাব খুলে ছেলেমেয়েদের পাহাড়ে ওঠার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। একই সঙ্গে নিজেও এভারেস্টে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।

মাখন একদিন হন্তদন্ত হয়ে আমার খোঁজে এল। ওর চুল, দাড়ি আগের চেয়ে আরও লম্বা হয়েছে। আমি অবাক হয়ে গেলাম, ‘আমাকে খুঁজছিস কেন?’

মাখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘দোস্ত, এখন শুধু তুই-ই অবিবাহিত আছিস। বাকি সবাই বিয়ে করে ফেলেছে। তোর বিয়ে ঠিক হলে আমাকে একটা খবর দিস। আমি তল্পিতল্পা নিয়ে গেরুয়া বসন পরে হিমালয়ের দিকে রওনা দেব। আর আসব না।’

মাখনকে আশ্বস্ত করলাম, আমার বিয়ে ঠিক হলে সবার আগে ওকেই খবরটা জানাব। বেচারা এত কষ্ট করে এভারেস্টে যাওয়ার ট্রেনিং নিয়েছে এত দিন! এখন এভারেস্টে যেতে না পারলে ওর পুরো পরিশ্রমটাই মাঠে মারা যাবে।