হারুন সাহেব ও আরও কজনের টেনশন

এই মুহূর্তে টেনশনে হারুন সাহেবের শরীর রীতিমতো কাঁপছেঅলংকরণ: আরাফাত করিম

‘ধ্যাত্তেরি, আজও লেট। হোয়াট দ্য পথ…!’

বিরক্তিটা যানজট নাকি নিজের ওপরই ঝাড়লেন শিমুল, বোঝা গেল না। মাসে তিন দিনের বেশি লেট হলে অফিসকর্মীদের কার কত বেতন কাটা যাবে, সে তালিকা তিনিই করেন। অথচ এ মাসে নিজেরই পাঁচ দিন লেট। মাস শেষ হতে আরও আট দিন বাকি। ব্যাপারটা বিব্রতকর। শিমুল মৃধা মানবসম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী। মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান তাঁর দূর সম্পর্কের খালু। ভাবলেন, ব্যাপারটা ম্যানেজ করতে হবে। কারণ, এবার পদোন্নতি পেলে তিনি হবেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। তারপর বিবাহপর্ব।

তাই মাথা ঠান্ডা রেখে শিমুল দাঁড়ালেন মানবসম্পদপ্রধানের রুমের সামনে। টেনশনে হালকা ঘামছেন তিনি…।

২.

‘বুঝলেন খালাম্মা, শেষ কবে গরুর মাংস চোখে দেখছি, মনে নাই। গরিবের দুঃখ কেউ বোঝে না…।’

‘অ্যাই, তুমি খালাম্মা ডাকছ কাকে, হুঁ?’ ধমকে উঠলেন যাত্রী, ‘আমাকে দেখতে খালাম্মার মতো লাগে? শোনো, আমি অবিবাহিত। বয়স মাত্র ২৬ চলছে...।’

‘সরি, আন্টি!’ বলেই জিবে কামড় দিলেন রিকশাচালক মতিন। এখন যে কী হয়! প্যাডেল ঘোরাচ্ছেন। চাকা ঘুরছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মতিনের টেনশন।

ওদিকে রিকশাযাত্রী মাইশা আছেন আরেক টেনশনে। তাঁকে কি ইদানীং দেখতে খালাম্মা খালাম্মা লাগে? মাসখানেক হলো জিমে যাওয়া হয়নি...!

৩.

‘মুরগি যদি জানত, ডিমের দাম এত বাড়ছে, তাইলে কিন্তু নিজেদের ডিমান্ড বাড়ায়া দিত...।’ বলেই হো হো করে হেসে ওঠেন ডিম ব্যবসায়ী নাদিম। নিজের কৌতুকপ্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ।

ক্রেতা কিছুটা বিরক্ত, ‘ডিমওয়ালা হয়ে মিমের ক্যাপশন বলছেন কেন?’

‘মিমের ক্যাপশন? এইটা আবার কী? ইয়ে…মিম কে?’ নাদিম টেনশনে পড়ে গেল।

উত্তর না দিয়ে এবং ডিম না কিনেই চলে গেলেন ক্রেতা। ডিম ব্যবসায়ীকে একটু টেনশনে ফেলে দিতে পারার সুযোগটা হাতছাড়া করলেন না।

নাদিমের কপালে চিন্তার ভাঁজ। তাহলে কি সাদিয়া জাহান মিমের প্রতি তাঁর কুসুম কুসুম ভালোবাসার কথা সবাই জেনে গেছে? আর লোকটা কে? মিমের কোনো বড় ভাই না তো? নাকি সাদাপোশাকের গোয়েন্দা?

নাদিম কি তবে ডিমের বাড়তি দাম হাঁকানো বাদ দেবেন? আর ঝুড়িতে রাখা নষ্ট ডিমগুলো? ওসব কী করবেন? টেনশন বাড়তে থাকে নাদিমের।

৪.

নিকট অতীতে কখনো এমনটা হয়নি হারুনের। তিনি এমনিতে হাসিখুশি মানুষ। ঠাট্টা–মশকরা করতে ভালোবাসেন। কিন্তু এই মুহূর্তে টেনশনে তাঁর শরীর রীতিমতো কাঁপছে। হারুন উদ্দিন দন্তচিকিৎসক। প্রতিদিন অনেক মানুষের দাঁতের চিকিৎসা করেন। একটু আগে যে রোগী এসেছেন, তাঁকে দেখামাত্র ‘আরে ভাই, আপনাকে এমন দাঁতভাঙা জবাব কে দিল?’ প্রশ্নটা করার পরই টেনশনে পড়ে গেছেন হারুন। কারণ, উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই লোকটি। তবে তাঁর সঙ্গে আসা ছেলেগুলো ধমকে উঠল। কেউ কেউ তেড়ে এল মারতে। আর তখনই, ওপরের মাড়ির সাতটা দাঁত হারানো ব্যক্তিটিকে চিনতে পারলেন হারুন। দরদি জনতা সংঘের সাধারণ সম্পাদক তিনি। ঠাট্টা করতে গিয়ে হারুন নিজেই এখন বিপদে। দন্তচিকিৎসক হয়েও নিজের দাঁতের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণ টেনশনে পড়ে গেলেন তিনি…।

৫.

ওপরের ঘটনাগুলোয় আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিলেন চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক মনোয়ার আহমেদ মন্টু। মূলত এসব তাঁর আসন্ন চলচ্চিত্র ‘টেনশন’–এর কয়েকটি দৃশ্যের খসড়া। চরিত্রগুলো এবার একসুতায় গাঁথতে হবে। নাচ–গান–ফাইট লাগবে। নিজের ফেসবুক আইডি থেকে লাইভ করতে হবে। ইউটিউব চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিতে হবে। দুয়েকটা বেফাঁস মন্তব্য করতেই হবে। কারণ, সিনেমা আলোচনায় আনতে হলে নিজেকে ভাইরাল করা ছাড়া উপায় নেই। মন্টু চাইছেন একটা সর্বজনীন সিনেমা বানাতে। তাই দর্শকের মধ্যে ‘সর্বজনীন টেনশন’ তৈরি করতে হবে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে পাবলিক নিজের পছন্দের অনেক জিনিসই খেতে পারছে না। তাঁর এই সিনেমা কি খাবে? এখন রাত সাড়ে ১১টা। মন্টু নিশ্চিত হলেন, এই টেনশনে রাত দুইটার আগে কিছুতেই তাঁর ঘুম আসবে না। টেনশন কমাতে কাগজ–কলম রেখে মুঠোফোন হাতে তুলে নিলেন মন্টু। ফেসবুকে রিল ভিডিও দেখতে দেখতে আরামসে দুটো বেজে যাবে। ব্যাপার না।

আরও পড়ুন