বলকান যুদ্ধ শুরু

সার্বিয়ান বাহিনী মিত্রোভিকা শহরে প্রবেশ করছে; কুমানভোর যুদ্ধে অটোমান সৈন্যরা; থেসালোনিকিতে গ্রীক রাজা প্রথম জর্জ এবং বুলগেরিয়ান জার ফার্দিনান্দ প্রথমের সাক্ষাৎ; বুলগেরিয়ান ভারী কামান

বলকান যুদ্ধের কিছু দৃশ্য
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী সাম্রাজ্যের একটা অটোমান সাম্রাজ্য। তুরস্কের ছোট একটা অঞ্চল থেকে শুরু করে কয়েক শতাব্দী ধরে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বিস্ত‍ৃর্ণ ভূমিতে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে তারা। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই বিস্ত‍ৃত অঞ্চল শাসন করলেও আঠারো ও ঊনিশ শতকের দিকে অটোমান সাম্রাজ্য তাদের প্রভাব হারাতে থাকে। এ সময় অটোমান সাম্রাজ্য অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার কাছে কয়েকটি যুদ্ধে হেরে গেলে ইউরোপে অটোমানদের পতনের সূচনা হয়। এরপর ১৯১২-১৯১৩ সালে সংঘটিত বলকান যুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ইউরোপ ছাড়তে বাধ্য হয় তারা।

তুরস্কের পশ্চিমাঞ্চলের ইস্টার্ন থ্রেস (ইউরোপীয় তুরস্ক) থেকে শুরু করে সার্বিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল সামগ্রিকভাবে বলকান অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। স্থানীয় বলকান পর্বতমালার নাম অনুসারে এ অঞ্চলকে বলকান নামে অভিহিত করা হয়। তুরস্কের ইস্টার্ন থ্রেস ও সার্বিয়া ছাড়াও বুলগেরিয়া, মেসিডোনিয়া, গ্রিস, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, মন্টিনিগ্রো, আলবেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, কসোভোসহ হাঙ্গেরি ও রোমানিয়ার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত হয়েছে বলকান অঞ্চল।

অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার সঙ্গে কয়েকটি যুদ্ধে হেরে যাওয়া এবং অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সমস্যার জন্য ১৮ শতক থেকে তুরস্ককে ইউরোপের ‘রুগ্ণ ব্যক্তি’ বলে আখ্যায়িত করা হতে থাকে। তুরস্কের এই দুর্বলতার সুযোগে তুরস্কের অধীনে থাকা বলকান জনগণ স্বাধীনতা লাভের জন্য বিদ্রোহ ও অশান্তি সৃষ্টি করতে থাকে। একইসঙ্গে বলকান অঞ্চলকে ঘিরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে পরস্পরবিরোধী স্বার্থ নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা হতে থাকে ঘনীভূত। আর এই সমস্যা থেকে একসময় শুরু হয় বলকান যুদ্ধ। তাছাড়া বলকান যুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল নব্য তুর্কিদের উগ্র জাতীয়তাবাদ। নব্য তুর্কিরা অটোমানদের অধীনে থাকা অঞ্চলগুলোতে জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে এবং কিছু ক্ষেত্রে গণহত্যাও চালায়।

পতাকা হাতে অটোমান সৈন্যরা
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

মন্টিনিগ্রো প্রথমে অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এর কিছু দিন পর অটোমান সুলতানের কাছে পাঠানো চরমপত্র প্রত্যাখ্যাত হলে ১৯১২ সালের ১৭ অক্টোবর সার্বিয়া, বুলগেরিয়া ও গ্রিসও যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধে জোট রাষ্ট্রসমূহের সম্মিলিত সেনাবাহিনী স্বল্পসংখ্যক ও কৌশলগতভাবে দুর্বল অবস্থানে থাকা অটোমান বাহিনীকে অল্প দিনেই পরাজিত করে। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় অটোমানশাসিত অঞ্চলগুলো ভাগাভাগি নিয়ে।

সমগ্র ইউরোপে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় ফ্রান্স, জার্মানি ও ব্রিটেনসহ ইউরোপের পরাশক্তিগুলো এই অঞ্চলে উত্তেজনা বন্ধের উদ্যোগ গ্রহণ করে। বলা যায়, তারা এই অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। বিবাদমান জাতিগুলোর প্রতিনিধিরা ১৯১২ সালের ডিসেম্বরে লন্ডনে বৈঠকে মিলিত হন। কিন্তু কয়েকটি অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বলকান মিত্রদের সঙ্গে অটোমানদের মতবিরোধ দেখা দেয়। পরবর্তী সময়ে পক্ষগুলো আলোচনার মাধ্যমে মতৈক্যে পৌঁছাতে সমর্থ হলেও জাতীয়তাবাদী নব্য তুর্কিরা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে এবং তাঁরা হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধারের অঙ্গীকার করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাঁরাও বিভিন্ন যুদ্ধে বিপর্যস্ত হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯১৩ সালের ৩০ মে সম্পাদিত এক চুক্তির মাধ্যমে মিত্র দেশগুলো অটোমান সাম্রাজ্যের ইউরোপীয় অংশে অবস্থিত প্রায় সব অঞ্চল ভাগাভাগি করে নেয়।

এই ঘটনাবলির পরোক্ষ ফল হিসেবে বলকানে স্বাধীন আলবেনিয়া রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তী সময়ে বুলগেরিয়া তার লব্ধ অংশ নিয়ে ক্ষুব্ধ হলে ১৯১৩ সালে জুন মাসে দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ শুরু হয়।

ইউরোপের রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী বলকান যুদ্ধের ফলে পুরো দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের মানচিত্র যায় বদলে। বলকান যুদ্ধ শেষ হলেও এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনা শেষ হয় না। এই উত্তেজনা থেকেই ১৯১৪ সালের বসনিয়ার একজন সার্ব জাতীয়তাবাদীর হাতে অস্ট্রিয়ান যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ ও তাঁর স্ত্রী নিহত হয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।

আরও পড়ুন