আরামপ্রিয় বাঘ

আঁকা: জুনায়েদ

অনেকেরই ধারণা, বাঁদর সব সময় বাঁদরামি করে। গাছের ডালে বসে বসে কলা খাওয়া ছাড়া জাতীয় জীবনে আর কোনো ভূমিকা নেই তাদের। অথচ জাতীয় জীবনে বাঁদরদের অবদান কম নয়—মনে মনে এ কথাই ভাবছিল জঙ্গলের সবচেয়ে তরুণ এবং উদীয়মান বাঁদর চিকু। সে এখন বসে আছে বাঘের গুহায়। সাধারণ বাঁদর হয়ে বাঘের গুহায় বসে থাকা যেনতেন ব্যাপার নয়। তাও আবার জঙ্গলের রাজা বেঙ্গল টাইগার হালুমের গুহায়। যে হালুমকে কর দিয়ে বেঁচে থাকে জঙ্গলের সাধারণ প্রাণীরা, চিকু এখন সেই হালুমের পা ধরে বসে আছে। বিপদে পড়ে বাঘের কাছে তদবির করছে না সে। আসলে হালুম নিজেই একটু বিপদের মধ্যে আছে। একটা হরিণের পেছন পেছন ছুটতে গিয়ে বেকায়দায় পড়ে পা মচকে গেছে তার। আর সেই পায়ে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে চিকু। হাতি গর্তে পড়লে চামচিকাও লাথি মারে, কিন্তু বাঘের ভাব আলাদা। সে গর্তে পড়ে পা মচকালে চিকুর মতো উদীয়মান বাঁদররা ব্যান্ডেজ করে।

তারপরও হালুমের মেজাজ খুব খারাপ। ক্যারিয়ারে এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো পা মচকেছে তার। তিনবারই হরিণের পেছনে ছুটতে গিয়ে। এ নিয়ে নাকি অনেকেই আজকাল জঙ্গলবুকে উল্টাপাল্টা স্ট্যাটাস দিয়ে সেলিব্রিটি হয়ে যাচ্ছে। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। ব্যাপারটা খেয়াল করে চিকু বলল, ‘বস!’

: বল।

: আপনার মুড অফ মনে হইতেছে?

: হ। এই লাইফ আর ভাল্লাগে না!

: কী কন বস!

: সকালে উইঠাই চিন্তা করতে হয় খাবারের কথা। চোরের মতো গিয়া হরিণ খুঁজি। কোনো দিন পাই, কোনো দিন পাই না। কী একটা টেনশন। তোর কী আরাম! কলাবাগানে গেলেই কলা, গাছে ফল। আর আমার হরিণ খুঁজতে খুঁজতেই রাত হইয়া যায়। অন্য কিছু কখন করুম?

: অন্য কী করতে চান?

: আরে, আমিও তো একটা বাঘ, নাকি? আমার কি সাধ-আহ্লাদ থাকতে পারে না? মন চাইল একটু ঘুরলাম, সিনেমায় অভিনয় করলাম, তা ছাড়া বয়স হইতেছে, প্রেম-ট্রেমও তো করা দরকার।

: তা-ও ঠিক। চিড়িয়াখানার দিকে যাবেন নাকি? খাওয়া নিয়া চিন্তা নাই। পাবলিক আপনারে দেখতে আসবে। ছবি তুলবে। আপনে অসুস্থ হইলে পত্রিকার ব্যাক পেজে নিউজ হবে।

: ভাবছিলাম একবার। ফ্রেন্ড সার্কেল আছে ওই দিকে। কিন্তু চিড়িয়াখানা জায়গাটা আমারে তেমন টানে না। প্রাইভেসি বইলা কিছু নাই ওইখানে। দুপুরে খাইয়া একটু ঘুমামু, এই সময় পাবলিক আইসা ডাকাডাকি, চিল্লাচিল্লি...এর চেয়ে এইখানেই ভালো আছি।

: কিন্তু এইভাবে আর কয় দিন বস? আপনি জঙ্গলের একাংশের রাজা। আপনি হরিণের পিছে পিছে দৌড়াইবেন, এইটা কেমন কথা? হরিণ নিজে আইসা আপনার জন্য ওয়েটিংয়ে থাকবে।

: যখনই হরিণের পিছে দৌড়াই, তখন ঠিক এটাই কল্পনা করি। কল্পনা করতে গিয়াই তো উষ্টাটা খাইলাম। যা-ই হোক, তোরে যে পয়েন্টে পয়েন্টে সিসি ক্যামেরা লাগাইতে কইলাম, তার কী করলি?

: বস, হইছে কী, ক্যামেরা তো ফিট করছিলাম। কিন্তু ওইখান থেইকা ন্যাট জিওর লোকজন ফুটেজ চুরি করে। তাই আপাতত বন্ধ রাখছি।

: তাইলে বিকল্প কিছু কর। হরিণ ট্র্যাক করা কঠিন হইয়া গেছে আজকাল। বডি স্প্রে মাখে শালারা। ঘ্রাণ পাই না ঠিকমতো।

: একটা বিকল্প আছে, যদি আপনি অনুমতি দেন। আমাদের শিয়াল ‘খাওন টোয়েন্টিফোর ডটকম’ নামে একটা বিজনেস শুরু করছে। অনলাইনে অর্ডার দিলে সে আপনার ঘরে খাবার ডেলিভারি দিয়া যাবে।

: তাই নাকি?

: জি বস। আপনারে আর হরিণের পিছে ছুটতে হবে না। হরিণ নিজেই আপনার ঘরে চলে আসবে। এখন আপনি বললে আমি সব ব্যবস্থা করতে পারি...

: কর কর। এখনই অর্ডার দে।

আস্ত একটা হরিণের অর্ডার দিল চিকু। হালুম দেখল, মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যেই শিয়ালের কর্মীরা ডেলিভারি দিয়ে গেল। সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে খাবারটা। মুগ্ধ হয়ে খেতে শুরু করল হালুম। বেশ টাটকা আর সুস্বাদু হরিণ। গত কমাসে এত মজার খাবার খায়নি সে। খুশি হয়ে জঙ্গলের কর আদায়ের দায়িত্বটা চিকুকে দিয়ে দিল হালুম।

রাতে খুব ভালো ঘুম হলো হালুমের। সকালে উঠেও বেশ নির্ভার লাগল নিজেকে। শিকারের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে না, রোদের মধ্যে ঘুরে ঘুরে কর আদায় করতে হবে না, মশার কামড় খেয়ে ঝোপে লুকিয়ে থাকতে হবে না ভেবে বেশ খুশি হলো সে। খাওন টোয়েন্টিফোর ডটকমে অর্ডার দিয়ে অনেক দিন পর বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে টিভি দেখার সুযোগ পেল সে।

সুখে জীবন কাটতে লাগল হালুমের। যদিও ওজন বেড়ে গেছে আগের চেয়ে। শুয়ে-বসে খেতে খেতে বড়সড় একটা ভুঁড়িও হয়েছে তার। বিশ্বের প্রথম ভুঁড়িওয়ালা বাঘ হিসেবে তাকে চালিয়ে দেওয়া গেলেও তাতে কোনো দুঃখ নেই হালুমের। এখন বন্ধুদের সঙ্গে স্কাইপে কথা বলার সুযোগ হয় তার। নতুন বন্ধুও হয়েছে অনেক। সাইবেরিয়ান এক বাঘিনীর সঙ্গে রাত-দিন কথা হচ্ছে ইদানীং।

একদিন চিকুর একটা কথা শুনে নির্বাক হয়ে গেল হালুম। সাবমেরিন কেব্‌ল না কী যেন কাটা পড়েছে। ইন্টারনেট অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। সাইবেরিয়ান বাঘিনীর সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করবে হালুম? খাবারের অর্ডারই বা দেবে কীভাবে?

কী আর করা। পরদিন সকালে উঠে বহুদিন পর হরিণ শিকারে বের হলো হালুম। কিন্তু একি! একটু হাঁটতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল সে, পা যেন এগোতেই চাইছে না। শরীর ভারী হয়ে গেছে। বিশাল ভুঁড়ি নিয়ে কিছুতেই দৌড়াতে পারছে না সে। কয়েক মিনিট দৌড়ের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে শেষে ঝোপের পাশে জিব বের করে হাঁপাতে লাগল হালুম। পাশ দিয়ে ভেংচি কেটে হেঁটে গেল কয়েকটা হরিণ। কিন্তু হালুম এত ক্লান্ত যে নড়তেই পারল না।

কম বয়সী একটা হরিণ এসে যখন বলল, ‘বস, চলেন, রেস লাগি।’ তখন রীতিমতো চোখে পানি চলে এল হালুমের। এত বড় অপমান! বহু কষ্টে ঘরে ফিরে এল সে। বসে পড়ল ধপ করে। প্রচণ্ড খিদে আর অপমানে শরীর ছেড়ে দিয়েছে তার।

চিকু এসে মেপে দেখল হালুমের প্রেশার হাই। ততক্ষণে হালুমের এই অক্ষমতার খবর পুরো জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়েছে। নানা রকম দুষ্টুমি ফাজলামি শুরু করেছে জঙ্গলবাসী। ভুঁড়িওয়ালা বাঘকে কর দেবে না তারা—এমন দাবিও উঠেছে। চিকু বলল, ‘বস, চিড়িয়াখানার সার্কুলার দিছে দেখলাম।’

: ওইখানে ওয়াই-ফাই আছে?

: আছে বস।

: তাইলে যোগাযোগ কর। আমি যাব।

কিছুদিন পর সবার কাছ থেকে বিদায় নিল হালুম। আবেগঘন কণ্ঠে হালুম বলল, ‘বন্ধুরা, তোমরা কেউ আমার মতো বেশি খাইয়ো না আর ইন্টারনেটের উপর নির্ভরশীল হইয়ো না। বেশি খাওয়া ভালো না।’

হালুমের বিদায়ে জঙ্গলের সবাই খুশি। এখন আর কর দিতে হবে না। বেশ কয়েকটা হরিণ এগিয়ে এল চিকুর দিকে। হরিণদের নেতা নিচু হয়ে কুর্নিশ করে চিকুকে বলল, ‘থ্যাংকস ভাই। তোমার বুদ্ধিমতো না চললে আমরা কোনো দিন হালুমের কবল থেকে মুক্তি পেতাম না।’

: বলেছিলাম না, কয়েক মাস কষ্ট করো, হালুমকে আমি জঙ্গল থেকে তাড়াবই। তাড়িয়েছি। মাঝখান দিয়ে কিছু ভেড়াকে বাঘের খাবার বানাতে হলো। যা হোক, এবার একটা স্ট্যাটাস দেওয়া যায়।

: কিন্তু কেব্‌ল না কী যেন একটা কাটা পড়েছে?

চিকু একটা মুচকি হাসি দিয়ে স্ট্যাটাস লিখতে শুরু করল।