পার্ক চুং-হিকে বলা হয় দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক উত্থানের জনক। স্যামসাং, এলজি, দাইয়ু, হুন্দাই, এসকে ও লোটে কেমিক্যালের মতো বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো পার্ক চুং-হি সরকারের গঠনমূলক শিল্পনীতির কারণেই গড়ে উঠেছিল। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল পার্ক ১৯৬১ সালে চরম দারিদ্র ও রাজনৈতিক সংকটে জর্জরিত দক্ষিণ কোরিয়ার শাসনভার গ্রহণ করেন। বিরোধী পক্ষের প্রতি দমন ও নিপীড়ন চালিয়ে সমালোচিত হলেও তাঁকে দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে সফল প্রসিডেন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোরীয় উপদ্বীপ ছিল জাপানের একটি উপনিবেশ। যুদ্ধে জাপান পরাজিত হলে জয়ী দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ৩৮ ডিগ্রি অক্ষরেখা বরাবর কোরীয় উপদ্বীপকে ভাগ করে নেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন উত্তর কোরিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে এবং যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতিষ্ঠা করে পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্র। জন্মলগ্ন থেকেই দুই কোরিয়ার সম্পর্ক ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্কের মতোই বৈরী। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত চলা কোরীয় উপদ্বীপের যুদ্ধে দুটি দেশই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া দক্ষিণ কোরিয়াকে আজকের এই অবস্থানে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান পালন করেন পার্ক চুং-হি।
রাজনৈতিকভাবে তিনি ছিলেন কর্তৃত্ববাদী। তাঁর শাসনামলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল নিয়ন্ত্রিত, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটত প্রতিনিয়ত। প্রেসিডেন্ট পার্ক ১৯৭১ সালের নির্বাচনে বিরোধী দলের কাছে প্রায় হেরে যেতে বসেছিলেন। এর পর থেকে ক্ষমতা হারানোর ভয়ে তিনি আরও কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠেন। পার্ক চিরস্থায়ী একনায়কত্ব নিশ্চিত করার জন্য নতুন সংবিধান প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বরে আদালত বিরোধী দল এনডিপির নেতা কিম ইয়ং-স্যামের চেয়ারম্যান পদ বাতিল করে। ফলে রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। গণতন্ত্রের দাবিতে শুরু হয় বিক্ষোভ। গোয়েন্দা সংস্থা কোরিয়ান সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (কেসিআইএ) পরিচালক কিম জে-কিউ প্রেসিডেন্ট পার্ককে এ বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু পার্ক জানিয়েছিলেন, পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে তিনি নিরাপত্তা বাহিনীকে সরাসরি গুলি চালানোর নির্দেশ দেবেন।
পার্কের এই মনোভাব মেনে নিতে পারেননি গোয়েন্দা প্রধান। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন প্রেসিডেন্ট পার্ক এত বেশি কর্তৃত্ববাদী হয়ে পড়বেন যে তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। তা ছাড়া কেসিআইএর পরিচালক পদ থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার একটা গুজব উঠেছিল। ফলে প্রেসিডেন্টকে হত্যা করার ব্যাপারে তিনি হয়তো মনস্থির করেছিলেন।
১৯৭৯ সালের ২৬ অক্টোবর একটি টিভি স্টেশন উদ্বোধন করতে যাওয়ার সময় পার্কের প্রধান দেহরক্ষী গোয়েন্দা প্রধান কিমকে পার্কের সঙ্গে একই হেলিকপ্টারে উঠতে বাধা দেন। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হন কিম। সেদিন রাতে সিউলের প্রেসিডেন্সিয়াল কম্পাউন্ডের ভেতর কেসিআইএ সেফ হাউসে একটি নৈশভোজে অংশ নিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট পার্ক। নৈশভোজে প্রেসিডেন্ট পার্ক গোয়েন্দা প্রধান কিমকে প্রতিবাদকারীদেরকে নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট দমনমূলক না হওয়ায় তিরস্কার করেন। কিম হঠাৎ নৈশভোজ থেকে বেরিয়ে যান এবং পিস্তল নিয়ে পুনরায় প্রবেশ করে প্রেসিডেন্ট পার্ক, তাঁর প্রধান দেহরক্ষীসহ ছয়জনকে হত্যা করেন। কিমের উদ্দেশ্য ঘিরে বিস্তর বিতর্ক আছে। কারণ, এটা অজ্ঞাত থেকে গেছে যে হত্যাকাণ্ডটি পরিকল্পিত অভ্যুত্থানের অংশ ছিল, নাকি নিছক আবেগপ্রবণ তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত।
স্বৈরাচারী শাসক হিসেবে নিন্দিত ও সমালোচিত হলেও শক্ত অর্থনৈতিক ভিত তৈরির মাধ্যমে যুদ্ধে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া দক্ষিণ কোরিয়াকে আজকের উন্নত দক্ষিণ কোরিয়ায় রূপান্তরে পার্ক চুং-হির অবদান দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।