টাইম সাময়িকীর শততম জন্মদিনে সেরা ১০০ প্রচ্ছদ

১০০ বছর আগে যাত্রা শুরু হয়েছিল টাইম সাময়িকীর। বিখ্যাত এই সাময়িকীর শততম জন্মদিন ছিল ৩ মার্চ। সময়ের সঙ্গে বদলেছে সাময়িকীটি। হাতে আঁকা ছবি, এরপর যন্ত্রের সাহায্য, সর্বশেষ কম্পিউটারে সফটওয়্যার ব্যবহার করে শিল্পীর আঁকা ছবিতে ছাপা হয়েছে এর প্রচ্ছদ। জন্মদিনে সেরা ১০০ প্রচ্ছদ প্রকাশ করেছে এই মার্কিন সাময়িকী।

১৯২৩ সালের ৩ মার্চ ‘টাইম’–এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। তখন থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে ছাপা হতো সাময়িকীটি। ২০২০ সালের পর থেকে পাক্ষিক আকারে প্রকাশিত হচ্ছে। ১৯২৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ হাজারের বেশি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। সেখান থেকে ১০০ প্রচ্ছদ বাছাই করেছেন প্রতিষ্ঠানটির ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ডব্লিউ ডি পাইন।

এই প্রচ্ছদ বাছাইয়ের গল্পও লিখেছেন পাইন। ‘টাইম’–এর প্রথম সংখ্যা নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘এটা জেনে মজা পেয়েছিলাম যে টাইমের প্রতিষ্ঠাতা হেনরি লুস ও ব্রাইটন হ্যাডেন প্রচ্ছদ চূড়ান্ত করতে সাময়িকী ছাপতে দেওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত দ্বিধায় ছিলেন। এমন ঘটনা এখনো মাঝেমধ্যে ঘটে।’

প্রথম প্রচ্ছদে ব্যবহার করা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার জোসেফ ক্যাননের ছবি। ছবিটি এঁকেছিলেন উইলিয়াম ওবারহার্ট। এই প্রচ্ছদের জন্য ৫০ মার্কিন ডলার নিয়েছিলেন তিনি। টাইম–এর এই সংখ্যা প্রকাশেরও দুই বছর আগে এই ছবি এঁকেছিলেন উইলিয়াম। ওই ৫০ ডলারের বিনিময়ে মাত্র একবার ছবিটি ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছিল টাইম সাময়িকী।

পাইন লিখেছেন, বিভিন্ন সময়ই তাঁকে একটা সেরা প্রচ্ছদ বাছাই করতে বলা হয়েছে। কিন্তু এই কাজ তিনি সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেছেন। কারণ, একটা প্রচ্ছদ বেছে নিলে অনেক পছন্দের প্রচ্ছদই তাঁকে এড়িয়ে যেতে হবে। তবে এবার এই কাজ না করে উপায় ছিল না তাঁর। প্রতিবছর থেকে একটা করে প্রচ্ছদ বেছে নিয়েছেন পাইন।

তবে এই ১০০ প্রচ্ছদ বাছাই করতে গিয়েও সমস্যায় পড়েছেন পাইন। বছরে যখন ৫২টি সংখ্যা ছাপা হতো, তখন এক বছরেই অনেক প্রচ্ছদ পছন্দের তালিকায় যুক্ত হতো। আবার পছন্দের অনেক প্রচ্ছদই তাঁকে বাদ দিতে হয়েছে।

টাইম যে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী সাময়িকী, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সাময়িকীতে আঁকা ছবি নিয়ে বই হয়েছে। কেন এসব আঁকা ছবি বিখ্যাত, তা নিয়েও বই হয়েছে। টাইমের ৭৫ বছর পূর্তিতে একটা বই বেরিয়েছিল। বইটার নাম ‘ফেসেস অব টাইম: ৭৫ ইয়ার্স অব টাইম ম্যাগাজিন কাভার পোট্রেটস’। পরে প্রকাশিত আরেকটির নাম ‘টাইম: দ্য ইলাস্ট্রেটেড হিস্ট্রি অব ওয়ার্ল্ড ইনফ্লুয়েনশিয়াল ম্যাগাজিন’। বই দুটিতে টাইমের প্রচ্ছদের নানান গল্প উঠে এসেছে।

জন্ম থেকেই টাইম ম্যাগাজিনের বর্ডার লাল ছিল না। ১৯২৬ সাল পর্যন্ত নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে টাইম। ১৯২৭ সালে এসে এই লাল বর্ডার দেওয়া শুরু হয়।

টাইম সাময়িকীর অন্যতম জনপ্রিয় আধেয় ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’। ১৯২৮ সাল থেকে এই বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করা হচ্ছে। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত এর নাম ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’ কিংবা ‘ওম্যান অব দ্য ইয়ার’ ছিল। এখন এর নাম বদলে ‘পারসন অব দ্য ইয়ার’। পূর্ববর্তী বছরের আলোচিত ব্যক্তিকে নিয়ে পরের বছর এই সংখ্যা প্রকাশ করা হয়। প্রথম ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’ হয়েছিলেন চার্লস লিন্ডবার্গ। এই মার্কিন বৈমানিক যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে ৩৩ ঘণ্টার বেশি সময় টানা বিমান চালিয়ে ফ্রান্সের প্যারিসে গিয়েছিলেন। তবে তাঁকে নিয়ে করা প্রচ্ছদও সেরা ১০০-তে জায়গা করে নিতে পারেনি।

ভারতীয়দের মধ্যে মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে করা প্রচ্ছদ এই ১০০-এর তালিকায় আছে। ম্যান অব দ্য ইয়ার হয়েছিলেন তিনি।

টাইমের প্রথম ১৫ বছরের প্রচ্ছদ প্রধানত ছিল সাদা-কালো। এই ১৫ বছরে ৭৮২টি সংখ্যার ৬৯৪টি প্রচ্ছদই ছিল সাদা-কালো এবং পুরুষের ছবি। তবে ১৯৩০-এর দশকের শেষ দিকে ডানা টাস্কার সম্পাদক হওয়ার পর এতে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। ১৯৪১ সালে তাঁর নেতৃত্বে নারীর ছবিতে প্রচ্ছদ হয়। মার্কিন অভিনেত্রী রিটা হেওয়ার্থের ছবি ছাপা হয় প্রচ্ছদে। সে সময় এমন ছবি ছাপানো বেশ ঝুঁকিপূর্ণই ছিল। তবে এতে সফল হয়েছিলেন ডানা টাস্কার, পেয়েছিলেন প্রশংসা।

টাইমে প্রথম গ্রাফিক প্রচ্ছদ ছাপা হয় ১৯৪৪ সালে। ওই বছর ৪ সেপ্টেম্বর প্যারিসের মানচিত্র দিয়ে করা প্রচ্ছদ। এ ছাড়া অ্যাডলফ হিটলারের মুখ এঁকে লাল ক্রসে কেটে দেওয়া প্রচ্ছদ ছাপা হয়েছিল ওই দশকেই।

১৯৫০-এর দশককে স্বর্ণযুগ বলেছেন টাইমের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ডব্লিউ ডি পাইন। সে সময় তিন আলোচিত শিল্পী এই সাময়িকীতে কাজ করেছেন। এই তিনজন হলেন বরিস আর্টজিবাশেফ, আর্নেস্ট হ্যামলিন বেকার ও বরিস চালিয়াপিন। পাইন লিখেছেন, তিন দশক ধরে এই শিল্পীরা নয় শতাধিক প্রচ্ছদ করেছেন।

পাইনের চোখে অন্যতম সেরা ১৯৬৬ সালের ৮ এপ্রিলের প্রচ্ছদ। ওই প্রচ্ছদে শিরোনাম ছিল ‘ইজ গড ডেড?’ তবে এতে কোনো ছবি ছাপা হয়নি। এর সঙ্গে একটি পাদটীকা দেওয়া হয়েছিল। এতে লেখা ছিল, ‘ঈশ্বর নিয়ে প্রচলিত যেসব ধারণা আছে, তার ওপর ভিত্তি করে কোনো শিল্পকর্ম খুঁজে পাওয়া যায়নি গত কয়েক মাসে। এতে সম্পাদকেরা এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে, এমন উপযুক্ত কোনো ছবি খুঁজে পাওয়া যাবে না।’

এই ১০০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ প্রেসিডেন্টই টাইমের প্রচ্ছদে স্থান পেয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশিবার স্থান পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। ৫৫ বার প্রচ্ছদে এসেছেন তিনি।

টাইমের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ডব্লিউ ডি পাইনের চোখে অন্যতম শক্তিশালী প্রচ্ছদ হলো, উপস্থাপিকা এলেন ডিজেনারেসকে নিয়ে করা ১৯৯৭ সালের একটা প্রচ্ছদ। ওই প্রচ্ছদের শিরোনাম ছিল, ‘ইয়েপ, আই অ্যাম গে’। এই প্রচ্ছদকে টাইমের অন্যতম ‘আইকনিক’ প্রচ্ছদ বলছেন তিনি।

পাইন ১৯৯৮ সাল থেকে টাইম সাময়িকীতে কাজ করেন। তিনি লিখেছেন, একটা সময় এসব প্রচ্ছদ আসত খামে করে ডাকযোগে। নিউইয়র্কের বিমানবন্দর থেকে এসব প্রচ্ছদের খাম সংগ্রহ করতে হতো। দেশের নানান প্রান্তে থাকা শিল্পীরা ছবি এঁকে পাঠিয়ে দিতেন। টাইমের এখন প্রচ্ছদ হয় ডিজিটাল মাধ্যমে। শিল্পী ছবি আঁকার পর তা ই–মেইলে পাঠিয়ে দেন কিংবা প্রচ্ছদের আধেয় ডাউনলোড করার জন্য একটি লিংক পাঠিয়ে দেন। কিন্তু সে সময় বিমানবন্দর থেকে প্রচ্ছদ সংগ্রহের উত্তেজনাকেই এগিয়ে রাখছেন পাইন।

সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে করা প্রচ্ছদও এই সেরা এক শর মধ্যে আছে। ২০১৭ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি সংখ্যার প্রচ্ছদটার শিরোনাম ছিল ‘এখানে দেখার কিছু নেই’।

পাইনের চোখে আরেকটা শক্তিশালী প্রচ্ছদ হলো ২০১০ সালে ৯ আগস্টের প্রচ্ছদ। ওই সংখ্যায় আফগান এক তরুণীর ছবি ছাপা হয়েছিল। আয়শা নামের ওই তরুণীর নাক ও কান কেটে নিয়েছিলেন তালেবান কমান্ডার। এই নারীর ছবি তুলেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার আলোকচিত্রী জোডি বিবার। তালেবানের পুনরুত্থানে আফগান নারীদের অবস্থা দেখাতে আয়শা এই ছবি তুলেছিলেন স্বেচ্ছায়।