যেদিন এক সন্তান নীতি থেকে সরে এল চীন

চীন সরকারের হিসাব অনুযায়ী, এক সন্তান নীতির ফলে চার দশকে ৪০ কোটি জন্ম রোধ করা গেছে
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীন। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও গত শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থান নেয় চীন। এ কারণে সমাজতান্ত্রিক দেশটির জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শূন্যের কাছাকাছি। জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখার জন্য যে পরিমাণ জন্মহার থাকা প্রয়োজন, দেশটির জন্মহার তার চেয়েও কম।

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে চীন ১৯৭৯ সালে কঠোর এক সন্তান নীতি চালু করে
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

১৬৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল ৫০ কোটি। এর ২০০ বছর পর পৃথিবীর জনসংখ্যা ১০০ কোটিতে পৌঁছায়। এরপর পৃথিবীর জনসংখ্যা দ্বিগুণ হতে সময় লাগে ৮০ বছর। জনসংখ্যা ২০০ কোটি থেকে ৪০০ কোটিতে পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র ৪৫ বছর। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, এ বছরের শেষের দিকে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৮০০ কোটিতে পৌঁছাবে। অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের পর ৪৭ বছরে পৃথিবীর জনসংখ্যা দ্বিগুণ হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই অস্বাভাবিক প্রবণতার ফলে পৃথিবী ধীরে ধীরে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে, দেশে দেশে দেখা দিচ্ছে খাদ্যসংকট।

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে চীন ১৯৭৯ সালে কঠোর এক সন্তান নীতি চালু করে। চীন সরকারের এই নীতি অনেক বিতর্কের জন্ম দেয়। এই নীতি ভঙ্গের কারণে অনেক দম্পতিকে গুনতে হয় জরিমানা, অনেকে হারিয়েছেন চাকরি, এমনকি জোরপূর্বক গর্ভপাতের ঘটনাও ঘটেছে। এই নীতির ফলে কন্যাসন্তানের ভ্রূণ নষ্ট করার প্রবণতাও দেখা হয়। ফলে চীনে কন্যাসন্তান জন্মহার যায় কমে। তবে প্রথমবার কন্যাসন্তান হলে গ্রামাঞ্চলের দম্পতিরা পরে আরও একটি সন্তান নিতে পারতেন। তা ছাড়া সংখ্যালঘু উপজাতি সম্প্রদায়ের দম্পতিরা একটি অতিরিক্ত সন্তান নিতে পারতেন।

চীনে জন্মহার (১৯৫০–২০১৫)
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

চীন সরকারের হিসাব অনুযায়ী, এক সন্তান নীতির ফলে চার দশকে ৪০ কোটি জন্ম রোধ করা গেছে। তবে এই নীতির ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঠেকানো গেলেও কমেছে যুবকদের সংখ্যা, অন্যদিকে বেড়েছে বয়সী মানুষের সংখ্যা। মানুষকে শুধুই সংখ্যা হিসেবে বিবেচনা করার এই নীতির বিরোধিতাও করেছেন অনেকে। তবে অনেকের মতে, গত তিন দশকে চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হলো এক সন্তান নীতি। এই নীতির ফলে নারীদের একটি বড় অংশ সন্তান লালন–পালনের কাজে নিয়োজিত থাকার পরিবর্তে শ্রমশক্তির অংশ হয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে।

প্রায় চার দশক পর চীন এক সন্তান নীতি থেকে সরে আসে। ২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবর চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া চীন সরকারের এ সিদ্ধান্তের কথা জানায়, যা ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়। সন্তান জন্মের হার উদ্বেগজনকভাবে কমে যাওয়ায় এবং ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের শ্রমবাজারে আরও ৩ কোটি শ্রমিক বাড়ানোর উদ্দেশ্যে পরিবার পরিকল্পনার নতুন এ নীতি গ্রহণ করে দেশটি। নতুন এই নীতির ফলে ৯ কোটি নারী সন্তান নেওয়ার সুযোগ পান। তবে সরকারের এই নতুন নীতির ফলে পরপর দুই বছর জন্মহার বাড়লেও পরে আবার কমতে শুরু করে। ২০১৬ সালে দেশটিতে ১ কোটি ৮০ লাখ শিশুর জন্ম হয়। ২০২০ সালে জন্ম নেয় ১ কোটি ২০ লাখ শিশু। অনেক ক্ষেত্রে প্রথমবার কন্যাসন্তান হওয়ায় দম্পতিরা দ্বিতীয় সন্তান গ্রহণ করেছেন।

দেয়ালে লেখা, ‘কন্যাশিশুদের প্রতি বৈষম্য, অবমাননা বা পরিত্যাগ করা নিষিদ্ধ’।
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

২০১৬ সালে দুই সন্তান নীতি চালু হলেও চীনে জন্মহার স্থায়ীভাবে বাড়েনি। শহরগুলোতে সন্তান বড় করার ক্রমবর্ধমান খরচ অনেক চীনা দম্পতির জন্য দ্বিতীয় সন্তান গ্রহণের ক্ষেত্রে একটা বড় অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে। তা ছাড়া দুটি সন্তানের পরিবর্তে একটি সন্তানের জন্য বিনিয়োগ করা অধিক যুক্তিসংগত বলে মনে করেন চীনা দম্পতিরা। ২০২১ সালে চীন সরকার ঘোষণা করে, এখন থেকে দম্পতিরা তিনটি সন্তান নিতে পারবেন। শ্রমশক্তি বৃদ্ধির কথা বিবেচনা করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়।