পৃথিবী থেকে গুটিবসন্ত নির্মূলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা

১৯৮০ সালে গুটিবসন্ত নিমূর্লের খবরটি দিয়েছিলেন ‘গুটিবসন্ত নির্মূল কর্মসূচি’র তিন পরিচালক
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

মানব ইতিহাসে গুটিবসন্ত প্রথম এবং একমাত্র সংক্রামক রোগ, যা শতভাগ নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে। ১৯৭৯ সালের ৯ ডিসেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই রোগ নির্মূলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় কয়েক হাজার বছর ধরে চলা গুটিবসন্ত রোগের প্রাদুর্ভাব।

গুটিবসন্ত এতটাই ভয়ানক রোগ ছিল যে গত শতাব্দীতে এই রোগে আক্রান্ত প্রতি ১০ জনের তিনজনেরই মৃত্যু হতো। যাঁরা বেঁচে যেতেন, তাঁদের ত্বকে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতচিহ্ন থাকত। কখনো কখনো আক্রান্ত ব্যক্তি স্থায়ীভাবে অন্ধ হয়ে যেতেন। গুটিবসন্তের জন্য দায়ী ভ্যারিওলা ভাইরাস। এই ভাইরাস দুই ধরনের হয়ে থাকে—ভ্যারিওলা মেজর ও ভ্যারিওলা মাইনর। গুটিবসন্ত রোগটির সঙ্গে ভ্যারিওলা ভাইরাসও পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

কালিঘাট চিত্রকলায় শীতলদেবী
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

গুটিবসন্ত রোগটির ইতিহাস অনেক পুরোনো। হাজার হাজার বছর ধরে মানবসভ্যতার ক্ষতি করেছে এই রোগ। ভারতীয় ইতিহাসে খ্রিষ্টপূর্ব দুই শতকে গুটিবসন্তের প্রথম বিবরণ পাওয়া যায়। প্রাচীন মিসরীয় মমিতে গুটিবসন্তের অণুজীবের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। প্রাচীন মিসরের অনেক রাজপরিবারের ধ্বংসের কারণ ছিল এই গুটিবসন্ত। প্রাচীন ভারতীয় পুরাণে ‘শীতলাদেবী’কে গুটিবসন্তের নিয়ন্ত্রক হিসেবে দেখা হতো। কোনো গ্রামে গুটিবসন্ত দেখা দিলে শীতলাদেবীকে গ্রাম থেকে সম্মানের সঙ্গে বিদায় দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সংস্কার পালনের রীতি ছিল।

ষষ্ঠ থেকে বিংশ শতক পর্যন্ত সারা বিশ্বে এই রোগ ব্যাপক প্রাণহানি ঘটায়। রোগটি ১৬৬৬-৭৫ সালে ইংল্যান্ডে মহামারি আকার ধারণ করে। ২০ শতকে অন্যতম প্রধান প্রাণসংহারক রোগ হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর সব মহাদেশে। সে সময় সারা বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ মারা যায় এই রোগের কারণে। গুটিবসন্তের কার্যকর টিকা আবিষ্কারের পর থেকে অনেক দেশ নাগরিকদের জন্য টিকা গ্রহণ বাধ্যতামূলক করে। ফলে ১৯ শতক ও ২০ শতকের প্রথম দিকে গুটিবসন্তের ঘটনা হ্রাস পেতে থাকে। ১৯৭৪ সালে গুটিবসন্তে ভারতে হাজার হাজার লোকের মৃত্যু হয়। এটি ছিল গুটিবসন্তের ইতিহাসের শেষ মহামারি।

দশক অনুযায়ী যেসব দেশে গুটিবসন্ত মহামারি আকার ধারণ করেছিল
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

একসময় বাংলাদেশে অনেক মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। কোনো কোনো গ্রামে গুটিবসন্ত মহামারি আকারে আবির্ভূত হতো এবং এতে গ্রামের হাজার হাজার মানুষ মারা যেত। ১৯৫৭-৫৯ সালে সংঘটিত ভয়াবহ মহামারিতে বাংলাদেশের ১ লাখ ১৫ হাজার লোক আক্রান্ত হয় এবং এর মধ্যে প্রায় ৮৬ হাজার জন মৃত্যুবরণ করে। এরপর দেশে ১৯৬১ সালে গুটিবসন্ত নির্মূল কার্যক্রম শুরু হয় এবং ব্যাপক টিকাদান করা হয়। ফলে ৭০ দশকের শেষের দিকে আক্রান্তের হার অনেক কমে আসে। বাংলাদেশে গুটিবসন্তের সর্বশেষ রোগী ছিল ভোলার তিন বছরের শিশু রহিমা বানু।

বাংলাদেশে গুটিবসন্তের সর্বশেষ রোগী ছিল ভোলার তিন বছরের শিশু রহিমা বানু
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

১৯৭৫ সালে রহিমার দেহে যখন গুটিবসন্তের জীবাণু পাওয়া যায়, তখন তাকে সবার থেকে আলাদা করে রাখা হয় এবং ওই এলাকায় সবাইকে গুটিবসন্তের টিকা দেওয়া হয়। তখনকার দিনে গুটিবসন্তের সন্ধান দিতে পারলে পুরস্কারের ঘোষণাও দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশকে গুটিবসন্তমুক্ত দেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

ইংল্যান্ডের চিকিৎসক ডক্টর এডওয়ার্ড জেনার ১৭৯৬ সালে গুটিবসন্তের টিকা আবিষ্কার করেন। এটি ছিল মানব ইতিহাসে প্রথম টিকা আবিষ্কার। টিকা প্রয়োগের মধ্য দিয়ে গুটিবসন্ত সৃষ্টিকারী ভ্যারিওলা ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধব্যবস্থা তৈরি করতে সক্ষম হন তিনি। এরপর দিনে দিনে গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে তৈরি করা হয়েছে আরও উন্নত ও কার্যকর টিকা।

গুটিবসন্তের টিকা
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

প্রতিটি প্রাণীর দেহে রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা আছে। প্রাণিদেহে কোনো ক্ষতিকর অণুজীব প্রবেশ করলে দেহের অ্যান্টিবডি এই অণুজীবের বিরুদ্ধে শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা গ্রহণ করে। কোনো কারণে প্রাণিদেহের অ্যান্টিবডি ক্ষতিকর অণুজীবকে চিনতে ব্যর্থ হলে বা তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম না হলে বিজ্ঞানীরা প্রাণিদেহে টিকা প্রয়োগের মাধ্যমে অ্যান্টিবডিকে অণুজীবটিকে চিনতে এবং তাকে ধ্বংস করতে সাহায্য করেন। এ ধারণার ওপর ভিত্তি করে সব ধরনের টিকা আবিষ্কার করা হয়।

১৯৪৮ সালে গঠিত হওয়ার পর থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই রোগ নির্মূলে বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। বিগত শতাব্দীর ৭০ দশকে গুটিবসন্ত শুধু আফ্রিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশের কিছু অংশে হানা দিয়েছিল। সর্বশেষ ১৯৭৭ সালের অক্টোবরে সোমালিয়ায় গুটিবসন্তে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়। এর দুই বছর পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পৃথিবী থেকে রোগটি পুরোপুরি নির্মূলের ঘোষণা করে। এটি ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ সাফল্য।