দাম্পত্যে তৃতীয় শক্তি
রুনা আমার আশা-আকাঙ্ক্ষা-আশঙ্কা সবই নষ্ট করে দিয়েছে।
রুনা আমার স্ত্রী। বিয়ের বয়স তিন বছর। এই তিন বছরেই আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। তার রয়েছে অনেক কারণ। প্রথম কারণ, রুনা তার শাশুড়ি, অর্থাৎ আমার মায়ের সঙ্গে কোনো বিষয় নিয়েই ঝগড়া করে না। এমনকি সাধারণ যে মন–কষাকষি, সেটিও তার ভেতরে নাই।
অথচ নাটক-সিনেমা দেখে বউ-শাশুড়ির সম্পর্ক নিয়ে আমার ভেতর তৈরি হয়েছিল বেদম আশা। আমি ধরেই নিয়েছিলাম রুনা আসবে, আসার পরই মায়ের সঙ্গে তার তুলকালাম বাধবে। মা চাইবে রুই মাছের ঝোল রাঁধতে, রুনা বলবে আলু-পটোল দিয়ে মাছ খায় গ্রামের মানুষেরা। শহুরে লোকেরা মাছ খায় কষিয়ে। কিন্তু ঘটনা তেমন হলো না… মা যেদিন তরিতরকারি দিয়ে মাছ রান্না করল, রুনা সেদিন জাপটে ধরল মাকে। বলল, আপনার হাতের রান্নার কী যে টেস্ট মা…পারলে আজ আমি আঙুল খেয়ে ফেলতাম!
ওদিকে রুনা যেদিন রুই মাছের কষা রাঁধল, মা সেদিন দুই প্লেট ভাত বেশি খেল। ডায়াবেটিসের ওষুধও বাড়িয়ে নিল। রুনাকে ডেকে শাসনের ভঙ্গিতে বলল, তুমি কি আমাকে মেরে ফেলতে চাও? এই বয়সে এত স্বাদের খাবার খাওয়াচ্ছ...প্লেটের পর প্লেট ভাত খেয়ে নিচ্ছি…এত খেলে বাঁচব?
এরপরই দুজন হঠাৎই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, কাঁদতে কাঁদতেই আবার দেখি হাসে। আমি ধুর বলে বেরিয়ে এলাম।
ধুর বলার কারণ আমার আছে।
ভেবেছিলাম বউ–শাশুড়ির গন্ডগোল হলে মাঝখান থেকে আমি নিজের কিছু ফায়দা করে নেব। এই যেমন রুনা এসে আমাকে বলবে, শোনো শাওন, তোমার মাকে বলে দিয়ো, আমি বাইরে গেলেও সালোয়ার- কামিজই পরব। শাড়ি আমি পরতে পারি না। শাড়ি পরলে নড়তে পারি না। আমি এই হাবিজাবির মধ্যে নেই।
আমি তখন বলব, আরে একটু মানিয়ে চলো না। শুনে রুনা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে। বলবে, তুমিও এই কথা বলছ। তুমিও দেখি সেই আদিম যুগের মানুষ। মানুষকে জামাকাপড় দিয়ে জাজ করো। আমি তখন বলব, আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি মায়ের সঙ্গে কথা বলছি।
এ কথায় রুনা ভাববে, আমি তাকে গুরুত্ব দিচ্ছি। সে তখন আমাকে গুরুত্ব দেবে। ফলে তার কাছ থেকে আমি পাব আলগা ভালোবাসা। ফেসবুকে আপ করা আমার ছবি ইগনোর না করে লাভ রিঅ্যাক্ট দেবে। জন্মদিনে ‘শুভ জন্মদিন’ না লিখে গালভরা একটা স্ট্যাটাস দেবে। কেক ও কেকের ছবি নিয়ে নানা রকম আহ্লাদ করবে।
ওদিকে মায়ের কাছে গিয়েও বলব, মা শোনো, রুনাকে আমি কঠিনভাবে বলে দিয়েছি, মা যা বলবে, তা–ই ঠিক। মা যদি বলে শাড়ি পরে বাইরে যেতে হবে, তাহলে রুনা যেন শাড়ি পরেই যায়।
মা বলবে, এভাবে বলতে গেলি কেন?
আমি বলব, তো আর কীভাবে বলব? আমি কি তোমার অন্য ছেলেদের মতো নাকি? আমার কাছে তুমিই শেষ কথা।
মা থমকে তাকিয়ে থাকবে। তার চোখে পানি চলে আসবে। তারপর আমার গালে হাত দিয়ে বলবে, এত ভালোবাসিস আমাকে? থাক, তোর বউকে বলিস…ও যা পরে বাইরে যেতে চায়, তা-ই পরবে। আমার এমন যে ছেলে…তার বউকে কি আর আমি কোনো কিছু বলতে পারি!
কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর হয় আরেক!
বাসায় ফিরে দেখি, মা আর রুনার ভেতর গুজুরগুজুর–ফুসুরফুসুর চলে। রাতদিন কী এত কথা যে তারা বলে, কে জানে! তারা নিজেদের নিয়েই এত ব্যস্ত থাকে যে আমি বাসায় একেবারেই অগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছি। আমি ডাকলাম, রুনা…
রুনার আওয়াজ এল—‘মায়ের সঙ্গে আছি। তুমি খেয়ে নাও। আমি আর মা পরে খাব।’
এরপরই ভেতর থেকে ভেসে এল দুজনের খিলখিল হাসি।
রাগে গা জ্বলে গেল। পরের দিনই মাকে গিয়ে বললাম, রুনা তোমাকে নিয়ে কী বলে জানো? সে বলে তুমি নাকি একটা অচল মানুষ। তোমার ধ্যানধারণা সবই খুব পুরোনো।
মা বলল, ‘রুনা বলেছে, তাহলে ঠিকই বলেছে। এ জন্যই সে সেদিন বলছিল, পুরোনো আর নতুন না মিললে কখনো ভালো কিছু হয় না। আমাকে আর রুনাকে তাহলে আরও মিলতে হবে রে বাবা!’
ধুর!
গেলাম রুনার কাছে। বললাম, শোনো, মা কিন্তু খুব চেতছে তোমার ওপর। তুমি নাকি সন্ধ্যায় চুল বাঁধো না। আসলে মা খুব সেকেলে মানুষ তো…
রুনা বলল, ‘না না। সেকেলে না, ব্যাপারটা একদম। এই তো সেদিন একটা রিলে দেখলাম, সন্ধ্যায় চুল বাঁধার নাকি একটা বৈজ্ঞানিক থিওরি আছে। বুঝছ? এরপর রিলটা পেলে তোমাকে পাঠাব!’
নাহ্! এভাবে হবে না। এই দুই বান্দার ভেতর ঠিক কী নিয়ে দ্বন্দ্ব হতে পারে, ভেবেই পাচ্ছি না। ঠিক তখনই টুং করে একটা শব্দ এল মুঠোফোন। দেখলাম, আমার অনেক বছর আগের বান্ধবী, বিদেশে থাকে, দেশে আসতে যাচ্ছে। কত যে মিস করছে আমায়, তা জানিয়েছে। সব শেষে দিয়েছে একটা লাভ রিঅ্যাক্ট!
সাব্বাস!
আমাদের দাম্পত্যে এখন ঠিক এটাই দরকার। দরকার একটা তৃতীয় শক্তি। না হলে যে দ্বন্দ্ব চাচ্ছি, দ্বন্দ্ব থেকে যে ফায়দা চাচ্ছি, সেটা সম্ভব নয়! আমি ডাক দিলাম, রুনা…শোনো…মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আমার এক পুরোনো বান্ধবী আসছে…নাম তার…
ও ঘরে হঠাৎই হাসাহাসির শব্দ থেমে গেল। আর আমার মুখে হাসি ফুটল তখনই।