সর্বকনিষ্ঠ বক্সার হিসেবে হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হন মাইক টাইসন

মাইক টাইসন
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

‘দ্য ব্যাডেস্ট ম্যান অন দ্য প্লানেট’ খেতাবটি নিজেই নিজেকে দিয়েছিলেন বক্সিং জগতের সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত তারকা মাইক টাইসন। অসামান্য গায়ের জোরে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেন সহজেই। ব্যক্তিজীবনে বহু ঘটনায় সমালোচিত মাইক টাইসন ১৯৮৬ সালের আজকের এই দিনে সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হন।

মাইকেল জেরাল্ড টাইসনের জন্ম নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে, ১৯৬৬ সালের ৩০ জুন। বক্সিং রিং দাপিয়ে বেড়ানো মাইক টাইসনের ছোটবেলা মোটেও সুখকর ছিল না। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার বাবা কে, তা আমি জানি না। জন্মের কাগজপত্রে বাবার নামের জায়গায় লেখা ছিল পারসেল টাইসন। কিন্তু তাঁকে আমি কখনো দেখিনি। পরে অবশ্য মা জানিয়েছিলেন বাবার নাম জিমি কার্লি ক্রিকপ্যাট্রিক। তাঁকে আমাদের বাড়িতে খুব কমই দেখেছি।’

টাইসন মাত্র সাত বছর বয়সে যৌন নিগ্রহের শিকার হন। ব্রুকলিনের রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে এক বৃদ্ধ তাঁকে যৌন নির্যাতন করেন। এই ঘটনা এবং পরবর্তী সময়ে আরও কিছু ঘটনা তাঁকে বিপথগামী করেছিল। তাঁর মা কাজ হারানোয় চরম দারিদ্রের মধ্যে পড়েন তাঁরা। ফলে অপরাধজগতে ভিড়তে দেরি হয় না তাঁর। চুরির দায়ে ধরা পড়ে পুলিশের কাছে মার খান। মা জানতে পেরে আরও মেরেছিলেন তাঁকে। অল্প বয়সে বিভিন্ন স্ট্রিট গ্যাংয়ের সঙ্গে যুক্ত হন। মা যখন মারা যান, তখন টাইসনের বয়স ১৬ এবং তখন তিনি দাগি অপরাধী।

১৯৭৮ সালে নিউইয়র্কের কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছিল তাঁকে। সেখানে ববি স্ট‍ুয়ার্ট নামের একজন তাঁর মধ্যে বক্সিংয়ের সম্ভাবনা দেখে পাঠিয়ে দেন বিখ্যাত প্রশিক্ষক কাস দা’মাতোর কাছে। পরে কাস দা’মাতো টাইসনের আইনি অভিভাবক হয়েছিলেন। অপেশাদার বক্সার হিসেবে টাইসন ২৭টির মধ্যে ২৪টি ম্যাচেই জয়ী হন। এরপর ১৯৮৫ সালে তিনি হন পেশাদার বক্সার। 

১৯৮৬ সালের ২২ নভেম্বর ২০ বছর বয়সী মাইক টাইসন ৩৩ বছর বয়সী ট্রেভর বারবিককে দ্বিতীয় রাউন্ডে মাত্র ৫ মিনিট ৩৫ সেকেন্ডে হারিয়ে দিয়ে সর্বকনিষ্ঠ খেতাবধারী হন। এর আগে তিনি ২৭টি ম্যাচের সবগুলোই জিতেছিলেন।

যেদিন সর্বকনিষ্ঠ বক্সার হিসেবে হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হলেন মাইক টাইসন
ছবি: এএফপি

তিনি মোট ৫৮টি হেভিওয়েট বক্সিংয়ে অংশ নিয়ে জেতেন ৫০টিতে। তার মধ্যে ৪৪টি নকআউট। এই নকআউটের তালিকায় ল্যারি হোমস, মাইকেল স্পিঙ্কস, টনি টাকার, ফ্র্যাঙ্ক ব্রুনোর মতো সুপারস্টার হেভিওয়েটরা ছিলেন। টাইসন হেরেছেন ৬টিতে। বাকি দুটি লড়াইয়ে পেয়েছিলেন ওয়াকওভার। ১৯৮৭ সালে টনি টাকারকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে টাইসন সর্বসম্মতভাবে বক্সিংয়ের তিনটি অনুমোদনকারী সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড বক্সিং অ্যাসোসিয়েশন’, ‘ওয়ার্ল্ড বক্সিং কাউন্সিল’ এবং ‘ইন্টারন্যাশনাল বক্সিং ফেডারেশন’ দ্বারা চ্যাম্পিয়ন হিসেবে স্বীকৃত হন। ১৯৯০ সালে ৩৭তম ম্যাচে প্রথম হারের মুখ দেখেন, বুস্টার ডগলাসের কাছে। জীবনের শেষ দুটি ম্যাচেও হেরে বিদায় নেন তিনি।

বিতর্ক কখনো পিছু ছাড়েনি তাঁর। ১৯৯৭ সালে কামড়ে ইভান্ডার হলিফিল্ডের কানের লতি ছিঁড়ে ফেলেন। এর ফলে তাঁর বক্সিং লাইসেন্স বাতিল করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৯ সালে লাইসেন্স ফিরে পান। সে বছর তিনি আবার কয়েক মাসের জন্য জেলেও যান। ২০০৩ সালে দেউলিয়া হন টাইসন।

১৯৮৮ সালে টাইসন অভিনেত্রী রবিন গিভেন্সকে বিয়ে করেন। টাইসন তাঁকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করতেন এমন অভিযোগে পরের বছর তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। এরপর টাইসন আরও দুবার বিয়ে করেন। ১৯৯১ সালে একটা সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার প্রতিযোগীকে ধর্ষণ করার অভিযোগে অভিযুক্ত হন এবং ১৯৯২ সালে দোষী সাব্যস্ত হলে ছয় বছরের জেল হয় তাঁর। তিন বছর পর ১৯৯৫ সালে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর টাইসন আবার বক্সিং শুরু করেন এবং দুটি চ্যাম্পিয়নশিপ বেল্ট পুনরুদ্ধার করেন।

২০১১ সালে আন্তর্জাতিক বক্সিং হল অব ফেমে অন্তর্ভুক্ত হন টাইসন। ২০১৩ সালে তাঁর স্মৃতিকথা ‘মাইক টাইসন: আনডিসপিউটেড ট্রুথ’ এবং ২০১৭ সালে ‘আয়রন অ্যাম্বিশন: মাই লাইফ উইথ কাস দা’মাতো’ প্রকাশিত হয়। বর্তমানে টাইসনের শারীরিক অবস্থা বেশ খারাপ, হুইল চেয়ার ছাড়া চলাচল করতে পারছেন না।

তরুণ বয়সে কিংবদন্তি বক্সার মোহাম্মদ আলীর জীবনীভিত্তিক সিনেমা ‘দ্য গ্রেটেস্ট’ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন টাইসন। সিনেমার শেষের দিকে পর্দায় হাজির হন স্বয়ং মোহাম্মদ আলী। তাঁকে দেখে টাইসন ঠিক করে ফেলেন মোহাম্মদ আলীর মতো বক্সার হবেন। এক সময় মোহাম্মদ আলীও স্বীকার করেছিলেন যে তাঁকে হারানোর সব ক্ষমতাই টাইসনের আছে। মাইক টাইসনের মতো কোনো বক্সার আর আসবে কিনা, সে এক বড় প্রশ্ন। এত বছর পরও বক্সিংপ্রেমীরা টাইসনের মতো সেরা এবং ক্ষ্যাপাটে কাউকে খুঁজে পায়নি।