যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন আব্রাহাম লিংকন

ইন্ডিয়ানা রাজ্যের স্পেন্সার কাউন্টির যে বাসায় বেড়ে উঠেছিলেন লিংকন
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

আব্রাহাম লিংকন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম এবং প্রথম রিপাবলিক দলের প্রেসিডেন্ট। তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বহু বছরের দাসপ্রথা বিলোপ করে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মহান বীর হিসেবে বিবেচিত হন। নৈতিক, সাংস্কৃতিক, সাংবিধানিক এবং রাজনৈতিক সংকটে তাঁর অবিচল নেতৃত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের বুকে উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির আধুনিকীকরণে তিনি অসামান্য ভূমিকা পালন করেন।

ত্রিশের দশকের শেষ দিকে লিংকন যখন ইউএস হাউস অব রিপ্রেজেন্টিটিভসের সদস্য
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

১৮০৯ সালে ক্যানটাকি অঙ্গরাজ্যের হডজেনভিলে কাঠের তৈরি একটি জীর্ণ ঘরে টমাস লিংকন ও ন্যান্সি লিংকনের দ্বিতীয় সন্তান আব্রাহাম লিংকনের জন্ম। হডজেনভিলে জন্ম হলেও আব্রাহাম তাঁর পরিবারের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে বসবাস করেন। ১৮১৬ সালে লিংকন পরিবার দক্ষিণ ইন্ডিয়ানার পেরি কাউন্টি নামক স্থানে থিতু হয়। বাবা টমাস লিংকন ছিলেন কখনো কৃষক, কখনো কাঠমিস্ত্রি। সংসারে সচ্ছলতা ছিল না তাঁদের। পেরি কাউন্টিতে আসার দুই বছর পর মারা যান আব্রাহামের মা ন্যান্সি লিংকন।

আব্রাহাম লিংকনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। ছিলেন মূলত স্বশিক্ষিত। বন্ধুদের পুরোনো বই সংগ্রহ করে পড়তেন। বন্ধুদের কাছ থেকে বই ধার করার জন্য কখনো কখনো মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতেন। তাঁর শিক্ষার পেছনে অবদান রাখেন তাঁর মা–বাবা। মাঝেমধ্যে কারও কাছ থেকে পড়ালেখার বিষয়ে সাহায্য পেলেও তা ছিল সামান্য।

১৮৩০ সালে আব্রাহামের পরিবার আবারও স্থানান্তরিত হয়ে চলে আসে দক্ষিণ ইলিনয়ের ম্যাকন কাউন্টিতে। এত দিন বাবাকে বিভিন্ন কাজে সাহায্য করলেও তাঁর নিজের কোনো উপার্জন ছিল না। মিসিসিপি নদীতে নৌকা চালানোর কাজ শুরু করার মধ্য দিয়ে তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। এরপর একটা দ্বৈত মালিকানাধীন মুদিদোকান চালান। ব্যবসাটি লাভজনক হলেও একসময় তিনি নিজের অংশটুকু বিক্রি করে দেন। এরপর কাজ শুরু করেন পোস্টমাস্টার হিসেবে। আইন বিষয়ে পড়াশোনার ইচ্ছা থাকলেও কোথাও ভর্তি হতে ব্যর্থ হন লিংকন। অগত্যা নিজে নিজেই পড়তে শুরু করেন আইনবিষয়ক বই। দুই বছর পর ইলিনয় বারে আইন বিষয়ে পড়ার সুযোগ পান। এ সময় তাঁর জীবনে আসে প্রেয়সী রুথলেজ, বিয়ে করতে চান তাঁকে। কিন্তু টাইফয়েড জ্বরে মারা যান রুথলেজ।

লিংকন জনসাধারণের সঙ্গে কাজ করে সামাজিক দক্ষতা অর্জন করেন। তাঁর কথা বলার প্রতিভার কারণে স্থানীয়দের কাছে হয়ে ওঠেন জনপ্রিয় ব্যক্তি। ১৮৩২ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও নেটিভ আমেরিকাদের মধ্যে ‘ব্ল্যাক হক’ যুদ্ধ শুরু হলে এলাকার স্বেচ্ছাসেবীরা লিংকনকে তাদের অধিনায়ক মনোনীত করেন। এই যুদ্ধে আব্রাহাম লিংকন তাঁর কৃতিত্বের জন্য প্রশংসিত হন। এরপর লিংকন হুইগ দলের সমর্থক হিসেবে স্থানীয় রাজনীতি যোগ দেন। ১৮৪২ সালে বিয়ে করেন ধনী ব্যবসায়ী ও আইনজীবীর কন্যা ম্যারি টোডকে। আব্রাহাম লিংকন ১৮৪৬ সালে ইলিনয়ের হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ নির্বাচনে জয়ী হন। এর মাধ্যমে তিনি জাতীয় রাজনীতিতে অবদান রাখার সুযোগ পান। এরপর রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে কয়েক বছর আইনজীবী হিসেবে কাজ করেন। ১৮৫৪ সালে ডেমোক্রেটিক দল প্রেইরি ল্যান্ডে দাসপ্রথা চালু করলে আব্রাহাম লিংকন এর বিরোধিতা করেন এবং পুনরায় রাজনীতিতে ফিরে আসেন। ১৮৫৬ সালে তিনি রিপাবলিকান দলে যোগ দেন। ১৮৬০ সালে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হন এবং ৬ নভেম্বর নির্বাচিত হন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট।

লিংকন যখন প্রেসিডেন্ট
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

তিনি বহু বছর ধরে চলে আসা দাসপ্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধ চলার মধ্যেই তিনি ১৮৬৩ সালে দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। এটি ছিল দাসপ্রথার বিরুদ্ধে নেওয়া পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ।

১৮৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধে ইউনিয়ন বাহিনী যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, তখন কনফেডারেটের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে পরিচিত জন উইলকস বুথ ওয়াশিংটন ডিসির ফোর্ডস থিয়েটারে আব্রাহাম লিংকনকে তাঁর মাথার পেছনে গুলি করে হত্যা করেন। এমন সময় তাঁকে হত্যা করা হয়, যখন আমেরিকান জাতির পুনর্মিলনের মহান কাজটি সম্পন্ন করার জন্য তাঁকে অনেক প্রয়োজন ছিল। আব্রাহাম লিংকন চলে গেছেন কিন্তু মানবতার সবচেয়ে অন্তরায় দাসপ্রথা বিলুপ্ত করে পৃথিবীর বুকে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।