আমার স্ত্রী মা হলো, আর আমি হলাম অজ্ঞান

অলংকরণ: একটু থামুন

নাটক–সিনেমায় দেখেছি, সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হলে স্বামী বাইরে পায়চারি করে। আহ্, কী সুন্দর সে দৃশ্য! গত কোরবানির ঈদের পরদিন সে রকম প্রস্তুতি নিয়েই হাসপাতালে যাওয়া। সেখানে গিয়ে দেখলাম, পায়চারি করার জন্য যথেষ্ট জায়গা আছে। জায়গাটা বেশ পছন্দ হয়ে গেল। পায়চারি করার সময় হাতটা কোথায় রাখব, মনে মনে সেটাও ভেবে রাখলাম। প্রথমবারের মতো বাবা হতে যাচ্ছি। সব মিলিয়ে দারুণ উচ্ছ্বসিত আমি। কত যে পরিকল্পনা মনের ভেতর উঁকিঝুকি মারছে!

একজনকে বলেও রেখেছিলাম, আমি যে খুব দুশ্চিন্তা নিয়ে পায়চারি করব, সে দৃশ্য ভিডিও করে রাখতে। না হলে বউ যে পরে বিশ্বাস করবে না! বরং অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে প্রথমেই প্রশ্ন করতে পারে, ‘আমি যখন অপারেশন থিয়েটারে ছিলাম, সে সময় তুমি বাইরে কী করছিলে?’

তাই পায়চারি করার দৃশ্য ধারণ করে রাখার এমন মহাপরিকল্পনা। এ যুগের স্বামীদের কত কিছুই না করতে হয়! কিন্তু জীবন তো নাটক–সিনেমা নয়। আগে থেকে লিখে রাখা চিত্রনাট্য অনুযায়ী জীবন চলে না। এ ছাড়া নাটক–সিনেমার চিত্রনাট্যে যা রাখা হয় না, তা–ই ঘটল আমার জীবনে। বলতে পারেন বড় বিপত্তি।

বউকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হবে, এ খবর শুনেই বউ ও অনাগত সন্তানের চিন্তায় অজ্ঞান হয়ে আমি নিজেই চলে গেলাম হাসপাতালের ইমার্জেন্সি পর্যবেক্ষণে। জ্ঞান ফেরার পর দেখি, আমাকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। শরীর একটু সচল হওয়ার পর জানলাম, পুত্রসন্তানের জনক হয়েছি।

অন্যদিকে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকতে যাচ্ছে বউ, স্বাভাবিকভাবে সে সময় আমার উপস্থিতি কাম্য। কিন্তু সাহস ও ভরসা জোগানোর জন্য আমি তার পাশে নেই। আমি যে ইমার্জেন্সিতে ভর্তি, স্বাভাবিকভাবে এ বিষয়টি ওকে কেউ জানাতে চায়নি। শেষ পর্যন্ত জানায়ওনি।

কিন্তু বউ বলে কথা। এই বিপদের সময় তার পাশে না থাকাটা তো ঝগড়া বাধানোর জন্য বিশাল এক উপলক্ষ। ইস্যুটা আমার জন্য এতটাই বেকায়দার যে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর আমাদের প্রথম ঝগড়ায় বউয়ের জয়ই সুনিশ্চিত ছিল। এমন সুযোগ কোন বউই–বা হাতছাড়া করতে চাইবে!

ওদিকে আমাকে পাশে না দেখে বউ ভেবে বসে আছে, আশপাশের কোনো খেলার মাঠে চলে গেছি। (বলে রাখা ভালো, আমার পেশা ক্রীড়া সাংবাদিকতা। ফলে আমি কারণে–অকারণে খেলার মাঠে ছুটে যাই।) তাই অপারেশন থিয়েটারে ঢুকতে ঢুকতেই সেখান থেকে বের হয়ে আসার পর আমার সঙ্গে ঝগড়ার অ্যাঙ্গেলটাও সে ঠিক করে রেখেছিল। (এটা কিন্তু বানিয়ে বলছি না, স্বয়ং বউয়ের মুখ থেকেই শোনা।) এবং ঠিকই সে অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে প্রশ্নটা করে ফেলল, ‘এতক্ষণ কোথায় ছিলে?’ কবি জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন বলেছিলেন, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’ বনলতার এ প্রশ্নে ছিল বুনোফুলের ঘ্রাণ। আর আমার বউয়ের প্রশ্নে ছিল খাঁটি শর্ষের ঝাঁজ! ভাগ্য ভালো, আমার উত্তর তৈরিই ছিল।

অলংকরণ: একটু থামুন

শেষমেশ আমার অজ্ঞান হওয়ার কথা শুনে বউ কিছুটা ঠান্ডা হলো। কিন্তু ঝগড়াটা যে করতে পারল না, সেটা নিয়ে একটা অস্বস্তি কি থেকে গেল? ভাবছি, প্রশ্নটা করব কি না। অবশ্য এতে আবার ঝগড়ায় উসকানি দেওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়!

সে যাকগে, ১০–১১ দিন পর এসে অজ্ঞান হওয়ার গল্পটা কেন বললাম, জানেন? আমি শুধু বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে চাই, স্বামীরাও মানুষ। আর এই আমি অজ্ঞান হয়ে আবারও সেটা প্রমাণ করলাম। স্ত্রীদের কাছে আমার কিংবা আমাদের এই দাবি হয়তো ধোপে টিকবে না! যাহোক, বন্ধুরা বলছে, ‘তোর বউ দিব্যি মা হয়ে গেল, আর তুই কিনা অজ্ঞান হয়ে গেলি? এই তোর মানসিক শক্তি?’

বন্ধুদের আর কী বলি! মায়ের কাছে যে সবকিছুই তুচ্ছ। মা হওয়ার জন্য আমার স্ত্রীকে অভিনন্দন!