টাইম ম্যাগাজিনের ‘পারসন অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হন গ্রেটা থুনবার্গ

সুইডেনের পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ
ছবি: রয়টার্স

সুইডিশ পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ সারা বিশ্বে পরিচিত মুখ। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে সফল হয়েছেন গ্রেটা। বিষয়টিকে বৈশ্বিক আন্দোলনে রূপান্তরিত করেছেন। বলা যায়, এই আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন কৈশোরেই।

গ্রেটার জন্ম ২০০৩ সালের ৩ জানুয়ারি সুইডেনের স্টকহোমে। ৮ বছর বয়সে তাঁর ‘অ্যাসপারজার সিনড্রোম’ ধরা পড়ে, যা একধরনের বিকাশগত ব্যাধি। এই ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষেরা একটা ধারণা বা আগ্রহের ওপর গভীরভাবে মনোনিবেশ করে। গ্রেটার ক্ষেত্রে এই বিষয় ছিল জলবায়ু পরিবর্তন। গ্রেটা বলেন, ‘আমার অনেকটা এমন মনে হচ্ছিল যে আমি যদি জলবায়ুর পরিবর্তন সম্পর্কে প্রতিবাদ না করি, তাহলে ভেতরে ভেতরে আমি যেন মারা যাচ্ছিলাম।’

এর কয়েক বছরের মধ্যে গ্রেটা নিজেকে পরিবর্তন করেন। হয়ে যান নিরামিষাশী এবং বিমান ভ্রমণ থেকে বিরত থাকেন। মা–বাবাকেও নিরামিষাশী হতে এবং বিমানে ওঠা এড়াতে রাজি করান তিনি।

গ্রেটা ২০১৮ সালে স্থানীয় এক পত্রিকায় জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে রচনা প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পান। একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সুইডেনের জাতীয় নির্বাচনের তিন সপ্তাহ আগে পার্লামেন্টের সামনে বসে পড়েন গ্রেটা। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আইনপ্রণেতাদের উদ্বুদ্ধ করতে ‘স্কুল স্ট্রাইক ফর ক্লাইমেট’ লেখা একটা ব্যানার নিয়ে শুরু করেন অবস্থান কর্মসূচি। এই আন্দোলন গ্রেটা একাই শুরু করেছিলেন। পরদিন থেকে অনেকেই তাঁর পাশে দাঁড়াতে শুরু করে। তাঁর এই আন্দোলন প্রচারমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলে।

আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে লাখ লাখ মানুষ একই আদলে আন্দোলন শুরু করে। সংসদ নির্বাচনের পর গ্রেটা আবার স্কুলে ফিরে যান। এরপর ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ নামে একটা আন্দোলন শুরু করেন। প্রতি শুক্রবার স্কুলে অনুপস্থিত থাকেন গ্রেটা। তাঁর এই অভিনব প্রতিবাদও অল্প দিনের মধ্যে সুইডেন এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রেটা ইউরোপজুড়ে ট্রেন ভ্রমণ শুরু করেন এবং বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দিতে থাকেন। গ্রেটা পুরো ২০১৯ সাল স্কুল থেকে ছুটি নেন।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ জলবায়ুবিষয়ক অধিবেশনে গ্রেটার আবেগপূর্ণ ভাষণ বিশ্বনেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। গ্রেটা নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা আমাদের স্বপ্ন ও শৈশব হরণ করেছেন। বিশ্বের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মানুষ মারা যাচ্ছে। পুরো বাস্তুতন্ত্র ভেঙে পড়ছে। আমরা একটা ব্যাপক বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে আছি। আর আপনারা শুধু অর্থ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গালগল্প করে যাচ্ছেন। কত বড় দুঃসাহস আপনাদের!’ বিমানের জ্বালানি পুড়লে তা পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে, এ কারণে গ্রেটা জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে বিমানের পরিবর্তে সৌরচালিত রেসিং ইয়টে যুক্তরাষ্ট্রে যান। দুই সপ্তাহে আটলান্টিক মহাসাগরের প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছান গ্রেটা।

গ্রেটা সে সময়ের মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর বেশ বিরক্ত ছিলেন। কারণ, ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের আগেই জলবায়ু সংকটের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন এবং ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি প্যারিসে স্বাক্ষরিত জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসেন। জলবায়ুবিষয়ক অধিবেশন শেষে গ্রেটা ও ট্রাম্প একে অপরের মুখোমুখি হন। গ্রেটাকে উপেক্ষা করে ট্রাম্প সাংবাদিকদের দিকে এগিয়ে যান। সে সময় গ্রেটার ভর্ৎসনাপূর্ণ তির্যক চোখে প্রেসিডেন্টের দিকে তাকানোর দৃশ্য উপস্থিত অনেক সাংবাদিকের ক্যামেরায় ধরা পড়ে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় ভূমিকা রাখার জন্য গ্রেটা অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। ২০১৯ সালে মনোনীত হয়েছিলেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য। ২০১৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর মাত্র ১৭ বছর বয়সী গ্রেটা টাইম ম্যাগাজিনের বর্ষসেরা ব্যক্তিত্ব নির্বাচিত হন তিনি। ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে তিনি এই গৌরব অর্জন করেন। টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে ‘দ্য পাওয়ার অব ইয়ুথ’ উপাধিতে ভূষিত করে।

শিক্ষা কার্যক্রম থেকে এক বছরের বিরতি শেষে স্কুলে ফিরেছেন গ্রেটা। হয়তো তিনি অচিরেই জলবায়ু আন্দোলনে ফিরে আসবেন এবং অধিক কার্বন নিঃসারণকারী উন্নত দেশের নেতাদের ঘুম কেড়ে নেবেন। জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা আপনাদের ওপর নজর রাখছি।’