কলম্বিয়ার নেভাদো দেল রুইজ আগ্নেয়গিরির ধ্বংসাত্মক অগ্ন্যুৎপাত

১৯৮৫ সালের নভেম্বরে নেভাদা দেল রুইজ
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

১৯৮৫ সালের ১৩ নভেম্বর কলম্বিয়ার নেভাদো দেল রুইজ আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম বিধ্বংসী অগ্ন্যুৎপাত। স্থানীয় বাসিন্দারা এই আগ্নেয়গিরিকে ‘ঘুমন্ত সিংহ’ বলে ডাকেন।

নেভাদো দেল রুইজ আগ্নেয়গিরির অবস্থান কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটা থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার পশ্চিমে আন্দিজ পর্বতমালায়। নেভাদো দেল রুইজ ‘প্যাসিফিক রিং অব ফায়ার’-এর মধ্যে অবস্থিত, যা প্রশান্ত মহাসাগরকে ঘিরে আছে এবং এটি এই অঞ্চলের কয়েকটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরির অন্যতম। প্রায় ২০ লাখ বছর ধরে এই আগ্নেয়গিরিতে অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছে। ১৯৮৫ সালের ১৩ নভেম্বর অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে। অগ্ন্যুৎপাতটি খুব বেশি শক্তিশালী ছিল না। তবে অগ্ন্যুৎপাতের ফলে প্রচুর লাভা ও উত্তপ্ত গ্যাস নির্গত হয়। পর্বতটির উপরিভাগ পুরু বরফে আচ্ছাদিত ছিল। লাভা ও উত্তপ্ত গ্যাসের তাপে বরফ গলে যায়। ফলে উত্তপ্ত গ্যাস ও লাভার সঙ্গে উত্তপ্ত পানি আশপাশের গ্রাম ছড়িয়ে পড়ে।

১৯৮৪ সালের নভেম্বরে ভূতাত্ত্বিকেরা নেভাদো দেল রুইজের কাছে ভূমিকম্পের ক্রমবর্ধমান মাত্রা পর্যবেক্ষণ করেন। এ ধরনের ভূমিকম্পকে অগ্ন্যুৎপাতের পূর্বলক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আগ্নেয়গিরির চূড়ায় সালফার জমা হওয়া ও আগ্নেয়গিরি থেকে ছাই নির্গত হওয়ায় ১৯৮৫ সালের অক্টোবরে জারি করা হয় সতর্কতা। তবে কর্তৃপক্ষ উচ্চমাত্রার অগ্ন্যুৎপাত হতে পারে, এমন ধারণা করতে ব্যর্থ হয়। ফলে আগ্নেয়গিরির আশপাশের মানুষদের সাধারণ প্রস্তুতি নিতে বলা হয়।

আগ্নেয়গিরির লাভা আর্মেরো শহরটিকে কার্যত ঢেকে ফেলেছিল
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

১৯৮৫ সালের ১৩ নভেম্বর বিকেলে নেভাদো দেল রুইজ বিস্ফোরিত হতে শুরু করে। আগ্নেয়গিরি থেকে লাভার স্রোত ৪ ঘণ্টায় প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে মাটি ক্ষয় করে এবং গাছপালা ধ্বংস করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। লাভার একটি প্রবাহ ৫০ কিলোমিটার দূরে লেগুনিলা নদীর অববাহিকায় আর্মেরো শহরটিকে কার্যত ঢেকে ফেলেছিল। শহরের মোট ২৯ হাজার বাসিন্দার মাত্র এক-চতুর্থাংশ প্রাণে বেঁচেছিল। আরেকটি প্রবাহ ক্লারো নদীর অববাহিকা দিয়ে নেমে চিনচিনা শহরের প্রায় ১ হাজার ৮০০ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়।

এই অগ্ন্যুৎপাতে মোট ২৩ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয় এবং প্রায় ৫ হাজার মানুষ হয় আহত। পাঁচ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি ধ্বংস হয় এবং পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুই লাখের বেশি মানুষ। নিঃসৃত পদার্থের মোট ওজন ছিল প্রায় ৩৫ মিলিয়ন টন।

বিজ্ঞানীরা সঠিকভাবে জানতেন না কখন অগ্ন্যুৎপাত ঘটবে। তা ছাড়া অগ্ন্যুৎপাতের সঠিক প্রতিরোধব্যবস্থা গ্রহণ করাও সম্ভব ছিল না। এই আগ্নেয়গিরিতে অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছিল ১৪০ বছর আগে। ফলে অগ্ন্যুৎপাতের সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে শহরবাসীদের ধারণা দেওয়া কঠিন ছিল। তা ছাড়া স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সম্ভাব্য পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে নাগরিকদের সতর্ক করতে ব্যর্থ হয়।

ছবির ঠিক মাঝখানে আর্মেরো শহর
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

এই দুর্যোগের অন্যতম ঘটনা হচ্ছে ওমায়রা সেনশেজ নামের ১৩ বছরের একটি মেয়ের মৃত্যু। মেয়েটি একটি বিধ্বস্ত ভবনের নিচে আটকা পড়ে। আড়াই দিন সংগ্রাম করে মারা যায় সে। মেয়েটিকে উদ্ধারে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয় কর্তৃপক্ষ। অগ্ন্যুৎপাতের হাজার হাজার মৃত্যুর ঘটনার মধ্যে মেয়েটির মৃত্যু পৃথিবীর মানুষকে বিশেষভাবে মর্মাহত করে। ওই কিশোরীর আটকা পড়ার ছবিগুলো বিশ্বব্যাপী বিপর্যয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে।