যে কারণে আমি কাজ করি না

আঁকা: আসিফ

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং আমি—পৃথিবীর এই দুটি বিষয় নিয়ে আমার আত্মীয়রা সব সময়ই অত্যন্ত হতাশ। আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই আমাকে দেখে গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তাঁদের ধারণা, পৃথিবীর বুকে আমি একজন আগাছা। আমাকে দিয়ে কোনো কাজই হবে না।

তাঁদের ধারণা একেবারে অমূলক নয়। আমি নিজেও তা-ই মনে করি। তবে নিকট অতীতে আমি শুধু কাজের প্রতি মনোযোগ দিয়েছিলাম। তখন সবাই বলতেন, ‘কী ব্যাপার, তুমি মানুষের সঙ্গে কথাটথা বলো না কেন? ভয় পাও নাকি?’

ক্রমাগত এই অভিযোগ শুনতে শুনতে একপর্যায়ে আমি কথা বলা শুরু করলাম। এখন আত্মীয়রা বলেন, ‘তুমি তো শুধু কথাই বলো, কোনো কাজ তো করতে দেখি না।’

তাঁদের কথার প্রতিবাদ কখনোই করি না আমি। কারণ, আমার এমন অনেক পারফরম্যান্স আছে, যা তাঁদের এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছে।

কদিন আগের ঘটনা বলি। চুপচাপ বসে আছি দেখে ভাবি এসে বলল, ‘কী করছিস?’

‘বাংলা চলচ্চিত্রে ছাগলের ভূমিকা নিয়ে ভাবছি। খুব ইন্টারেস্টিং।’

‘মানে?’

‘হ্যাঁ। ছাগলকে কখনো দেখা যায় নায়িকার সঙ্গে। নায়িকা ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যায় ছাগলকে। কখনো আবার ছাগলছানা কোলে নিয়ে নাচ-গান করে। ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশ যে ওপরের দিকে, তার প্রতিফলন কিন্তু চলচ্চিত্রে আছে। অথচ সমালোচকেরা বলেন চলচ্চিত্র জীবনমুখী নয়...’

‘চুপ কর ছাগল, যা, একটা মিস্ত্রি নিয়ে আয়। ড্রয়িংরুমের সুইচবোর্ডটা কাজ করছে না।’

আমি আগেও খেয়াল করে দেখেছি, যখনই কোনো গভীর ভাবনায় থাকি, তখনই এসব অদ্ভুত আদেশ এসে পড়ে আমার ওপর। ভরদুপুরে মিস্ত্রি পাব কোথায়? খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ দেখি বিদ্যুতের থামে সাইনবোর্ড। তাতে লেখা ‘থাই মিস্ত্রি—বাসায় গিয়ে কাজ করি’। বাহ্! দেশে এখন বিদেশি মিস্ত্রিও কাজ করছে! দারুণ তো! ভাবলাম, বাসার সবারই খুব বিদেশপ্রীতি আছে। তাই সাইনবোর্ডের নম্বরে ফোন দিলাম। ফোন ধরলেন দোকানদার ভদ্রলোক। থাই মিস্ত্রির কথা জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘ঠিকানা দেন, মিস্ত্রি চলে যাবে।’ আমি ঠিকানা দিয়ে দিলাম।

বাসায় আসার পর ভাবি যখন বলল, ‘তুই একা কেন? মিস্ত্রি কই?’ তখন বেশ ভাব নিয়ে বললাম, ‘মিস্ত্রি আসছে। সুদূর থাইল্যান্ড থেকে আগত। হাই কোয়ালিটি।’ একটু পর কলবেল বাজল। ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দেখি ছোটখাটো আকারের এক লোক। থাই নয়, খাঁটি বাংলাদেশি। ভদ্রলোক বললেন, ‘ভাই, থাই গ্লাসের কাজ করানোর জন্য ফোন দিছিলেন?’

তার পরের ইতিহাস আর বলতে চাই না। কীভাবে যেন পুরো এলাকায় প্রচার হয়ে গেল আমার বোকামির কথা। এ জন্যই কোনো কাজের ঝামেলায় যেতে চাই না আমি। সত্যি কথা বলতে, কাজ করতে আমার ভালোই লাগে না। সবাই তো কোনো না কোনো কাজ করছে, তাহলে আমি কেন কাজ করব? সবাই যা করছে, আমাকেও কি তাই করতে হবে? তা ছাড়া বুদ্ধিমানেরা সব সময়ই কাজ করেন একটা আরামপ্রিয় ভবিষ্যতের জন্য, যেখানে তাঁকে কোনো কাজ করতে হবে না। পায়ের ওপর পা তুলে খেতে পারবেন। এই যেমন আমাদের পাশের বাড়ির জগলুল সাহেব। দিনরাত পরিশ্রম করছেন। নয়টা-পাঁচটা অফিস শেষে বাড়ি ফিরে দোকানে বসেন। কী কঠিন জীবন! তাঁর উদ্দেশ্য একটাই, ‘ভাই, বেশি না, ১০টা বছর চাকরি করব। বলদের মতো খাটব।’

‘তারপর?’

ম্যাচ রেফারির কাজ কী? বসে বসে খেলা দেখা। আমিও তো তা-ই করি। ম্যাচ রেফারি টাকা পান বলে তাঁরটা কাজ, আর আমারটা কাজ নয়, এটা আবার কোন বিচার?

‘তারপর আর কিছু না। আরাম করব বসে বসে। পত্রিকা পড়ব, টিভি দেখে “দেশটা শেষ করে দিল”-টাইপ গালি দেব রাজনীতিবিদদের। এই তো।’

তো আমি যদি এখনই সেই আরামপ্রিয় জীবনটা যাপন করি, তাহলে সমস্যা কোথায়? শুধু রাজনীতিবিদদের গালি দেওয়ার জন্য আমি প্রতিদিন নয়টা-পাঁচটা অফিস করব কেন, তা কিছুতেই মাথায় ঢোকে না আমার।

তা ছাড়া কোনটাকে কাজ বলা হয়, সেটাও আমি বুঝি না। বন্ধুর বিয়েতে গিয়ে পড়লাম মুরব্বিশ্রেণির এক আত্মীয়ের রুটিন জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে। মুখে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব এনে তিনি বললেন, ‘তুমি ছেলের বন্ধু, তাই না? তো কী করো তুমি?’

‘জি...বই পড়ি, খেলা দেখি।’

‘বাহ্, খুব ভালো। আর কী করো?’

‘ঘুরে বেড়াই, সিনেমা দেখি।’

‘আমি বলতে চাইছি কাজের কথা। ওগুলো করে তো টাকা আসে না। পেশা কী তোমার?’

কী আশ্চর্য! তার মানে কাজ নয়, টাকাটাই আসল? কিন্তু এসব করার জন্যও কিন্তু মানুষ প্রচুর টাকা পায়। ম্যাচ রেফারির কাজ কী? বসে বসে খেলা দেখা। আমিও তো তা-ই করি। ম্যাচ রেফারি টাকা পান বলে তাঁরটা কাজ, আর আমারটা কাজ নয়, এটা আবার কোন বিচার?

এমন চিন্তার কারণে কেউ আমাকে কাজ দিতে চায় না। দিলেও খুব ভয়ে থাকে। সেদিন স্বচ্ছ স্কচটেপ কিনতে পাঠাল ভাইয়া। বাসায় একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে। টেপ লাগবে। ভাইয়া টাকা দেওয়ার পর পিঠে হাত দিয়ে কোমল গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘পারবি তো? কোন টেপ বুঝছিস? কার্টন টেপ। বড়, সাদা মানে ট্রান্সপারেন্ট, মোটা টেপগুলা থাকে না? ওইগুলা লাগবে। পারবি না আনতে?’ আমিও পাটিগণিতের কঠিন এক অঙ্ক দেওয়া হয়েছে—এমন একটা ভাব নিয়ে বললাম, ‘চেষ্টা করব।’

‘যা তাহলে। আল্লাহ ভরসা।’

তারপর আর কী! দোকানে গেলাম, টেপ কিনলাম এবং চলে এলাম। শতভাগ সাফল্য। কিন্তু আমি জানতাম, এ সাফল্যই কাল হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, বড় ভাই-বোনদের অন্যতম কাজ হলো প্রয়োজন কিংবা অপ্রয়োজনে ছোটদের কাজে লাগানো। একটু পর বিভিন্ন দিক থেকে কাজের নির্দেশ আসতে লাগল।

‘অ্যাই, কাচের জগটা এখান থেকে নিয়ে ওই টেবিলে রাখো তো।’

‘মিষ্টিগুলো নিয়ে যাও।’

‘ফলগুলো সাজিয়ে রেখেছ?’

আমিও প্রশ্ন অনুযায়ী উত্তর দিলাম।

‘কাচের জিনিস আমার নেওয়া কি ঠিক হবে? কীভাবে যেন আমার হাত থেকে সব সময় কাচের জিনিস ভাঙে।’

‘থাক, তোমার নিতে হবে না। ফলগুলো সাজাও।’

‘কীভাবে সাজাব? আগে আপেল দেব না আঙুর?’

‘আঙুর।’

‘সবুজ আঙুর আগে দেব? নাকি কালো আঙুর?’

‘কী যন্ত্রণা! আচ্ছা ফল আমি সাজাচ্ছি। তুমি মিষ্টিগুলো নিয়ে যাও। ভালোমতো দেখে নিয়ো।’

আমি প্রতিটা প্যাকেট খুলে মিষ্টি খেয়ে টেস্ট করে তারপর প্লেটে নিলাম। বেশ ভালো লাগল। অবশ্য এ কাজটাও আমাকে পুরো করতে হলো না। কারণ, আমার দেরি দেখে তারা নিজেরাই এসে মিষ্টি নিয়ে গেল।

আঁকা: আসিফ

কাজের প্রতি উদাসীন থেকে এটাই আমার লাভ। আমি জানি, যখনই কোনো কাজ সাফল্যের সঙ্গে করব, তখন আরও আদেশ আসবে। কাজের আদেশ আসা খারাপ নয়, কিন্তু কাজের চেয়ে অকাজের আদেশই বাংলাদেশে বেশি আসে। তা ছাড়া কাজের স্বীকৃতিও নেই। এই যে আমি সাফল্যের সঙ্গে একটা স্কচটেপ আনলাম; কেউ বলল না, ‘বাহ্, ভালো কাজ করেছ।’ কিন্তু যখনই আমি কোনো কাজ ঠিকভাবে করতে পারব না, সবাই এসে বলবে, ‘এটা কী করলা? একটা কাজও হয় না তোমাকে দিয়ে।’ শুধু স্কচটেপ কেনা নয়, অফিস-আদালতসহ আরও বড় বড় কাজেরও কোনো স্বীকৃতি নেই। মানুষ কত কিছু করছে। শুধু প্রশংসাটাই করছে না। কিন্তু যেই কেউ ভালো করতে পারল না, সবাই মিলে মৌমাছির মতো হামলা করল তার ওপর। অথচ সে কিন্তু আগেও ভালো করেছে, ভবিষ্যতেও হয়তো করবে। কিন্তু ওই যে, একেক দেশের একেক নিয়ম। তাহলে আমি কেন কাজ করব? তবু কিছু মানুষ আছে, যারা নিরলসভাবে কাজ করে যায়। যেমন আমার ছোট ভাই কবির।

বারবিকিউ হবে। কয়লার দরকার, ‘কবিইইইর কয়লা আনো।’

মুরগি কিনতে হবে, ‘কবিইইইর...মুরগি কিনে আনো।’

‘পেপসি আনো নাই? সবকিছু বলতে হবে? এটা তো জানা কথা যে পেপসি লাগবে। যাও, নিয়ে আসো।’

‘শুধু পেপসি আনছ? আশ্চর্য। সেভেন আপ আনতা দুইটা। আচ্ছা যাও, এখন নিয়ে আসো।’

‘দুইটা সেভেন আপই তো নরমাল। একটা ঠান্ডা আনতে পারলা না? যাও, একটা বোতল ফ্রিজে রাখো।’

‘ফ্রিজ নষ্ট? কবিইইইর, ফ্রিজের মিস্ত্রি ডাকো। আর আমার ফোনে ১০০ টাকা রিচার্জ করো। কী আশ্চর্য, ওয়াই-ফাই কাজ করছে না কেন? অ্যাই কবিইইইর, ওয়াই-ফাইওয়ালাকে ফোন দাও না...কার সঙ্গে ফোনে কথা বলছ তুমি?...ফ্রিজের মিস্ত্রির সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এত কিসের কথা? দেখি, পেপসিটা এনে দাও তো। গলা শুকিয়ে গেছে। ও কী...গ্লাস কে আনবে, কবিইইইর!!!’

একসময় কবির বিরক্ত হয়। রেগে চিৎকার-চেঁচামেচি করে, ‘আমাকে আর কোনো কাজ করতে বলবা না!’ বলে হুমকি দেয়। কিন্তু তারপরও সে আবার এই কাজগুলো করে। কারণ, কাজ করতে ওর ভালো লাগে।

আমার সঙ্গে এই জায়গাটাতেই ওর বড় অমিল। কাজ করতে আমার একদম ভালো লাগে না, তাই আমি কাজ করি না।