হিটলারকে হত্যার পরিকল্পনাকারী জেনারেলের আত্মহত্যা

১৯৩৯ সালে পোল্যান্ডে হিটলারের সঙ্গে রোমেল (বাঁয়ে)
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

১৯৪৪ সালের ১৪ অক্টোবর। আহত জেনারেল এরউইন রোমেলের বাড়িতে হাজির হন হিটলারের দুই নাৎসি জেনারেল। রোমেলকে তাঁরা বলেন, হয় তিনি হিটলারকে হত্যার পরিকল্পনার জন্য সরাসরি হিটলারের কাছে জবাবদিহি করার সুযোগ পাবেন অথবা এখনই সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করতে পারেন। দ্বিতীয় পথটাই বেছে নেন রোমেল। দুই জেনারেলের সঙ্গে উঠে পড়েন গাড়িতে। ওই গাড়িতেই সায়ানাইড পিল খেয়ে আত্মহত্যা করেন ‘দ্য ডেজার্ট ফক্স’ নামে খ্যাত দুই বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম সেরা এই যোদ্ধা।

১৯৪০ সালে প্যারিস ভিক্টরি প্যারেডে রোমেল
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

এরউইন রোমেলের জন্ম ১৮৯১ সালে জার্মানির হাইডেনহেইমে। ১৯১০ সালে একজন ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন সামরিক বাহিনীতে। ১৯১৪ সালে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে তাঁকে পাঠানো হয় ভার্দুনে। কমান্ডার হলেও তিনি সম্মুখসারিতে থেকে যুদ্ধ করতেন। যুদ্ধে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বনের পাশাপাশি তাঁর অসমসাহসিকতার জন্য অল্প সময়ের মধ্যেই অর্জন করেন খ্যাতি।

১৯১৭ সালে ‘কাপোরেতো’ যুদ্ধে মাত্র ১৫০ জন সৈন্য নিয়ে ঢুকে পড়েন ইতালীয় বাহিনীর এলাকায়। ইতালীয় বাহিনীকে বিভ্রান্ত করার মধ্য দিয়ে তিনি ইতালির ৯ হাজার সৈন্যকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে তাঁকে সামরিক স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

১৫ বছর শিক্ষকতা করার পর তাঁকে করা হয় সাঁজোয়া রেজিমেন্টের প্রধান। গসলারে পাঠানো হয় সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। ১৯৩৭ সালে হিটলার রেজিমেন্ট পরিদর্শনের জন্য সেখানে গেলে হিটলারের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। এরপর রোমেলের হাতে তুলে দেওয়া হয় হিটলারের সদর দপ্তরের পাহারাদার সেনাদের কমান্ডারের দায়িত্ব।

১৯৪০ সালে ফ্রান্সে রোমেল ও তাঁর বাহিনী
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে রোমেলকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ১৯৪০ সালে তাঁকে পাঠানো হয় ফ্রান্সে। পুরো ফ্রান্স দখল করার পর যুদ্ধরত ইতালীয় বাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য রোমেলকে পাঠানো হয় উত্তর আফ্রিকায়। তাঁর মূল দায়িত্ব ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রতিপক্ষ ইতালিকে লিবিয়ায় অবস্থান বজায় রাখতে সাহায্য করা। কিন্তু তিনি কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করে লিবিয়ায় ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর হামলা করেন। ফলে হিটলার তাঁকে সেখান থেকে প্রত্যাহার করে ফ্রান্সের উপকূলে পাঠিয়ে দেন। যদিও এই হামলায় বীরত্ব ও সাফল্যের জন্য তিনি ‘দ্য ডেজার্ট ফক্স’ উপাধি পেয়েছিলেন।

দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ায় হিটলারের ওপর অসন্তুষ্ট হন রোমেল। ফলে হিটলারের ভুলগুলো তাঁর কাছে প্রকট হতে থাকে। এদিকে ফ্রান্সে মিত্রবাহিনীর আচমকা আক্রমণে অপ্রস্তুত হয়ে পড়া জার্মান বাহিনী একের পর এক দখলকৃত এলাকা হারাতে থাকে। মিত্রবাহিনীর বোমার আঘাতে গুরুতর আহত হন রোমেল।

রোমেলের শেষকৃত্যের মিছিল
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে হিটলারের কনফারেন্স রুমে বিস্ফোরক ভর্তি ব্রিফকেস নিয়ে হিটলারকে হত্যার চেষ্টা করেন জেনারেল স্টাফেনবার্গ। তাঁর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং তিনি ধরা পড়েন। জেরার মুখে তিনি সব ষড়যন্ত্রকারীর নাম প্রকাশ করেন এবং এর মধ্যে রোমেলের নামও ছিল। ধারণা করা হয়ে থাকে, রোমেল প্রথম দিকে পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত থাকলেও তিনি হিটলারকে হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।

হারলিংগেনের এই স্থানেই আত্মহত্যা করেছিলেন রোমেল
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

প্রথম থেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে নৃশংসতা পছন্দ করতেন না এরউইন রোমেল। একজন জেনারেল হয়েও যুদ্ধের চেয়ে কূটনৈতিক সমাধানে আগ্রহী ছিলেন তিনি। দেরিতে হলেও হিটলারের আগ্রাসনের প্রতি তাঁর মোহভঙ্গ হয়েছিল। তাই হয়তো হিটলারের আগ্রাসন থামাতে চেয়েছিলেন। এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করতে গিয়ে আত্মবিসর্জন দিতে হয় তাঁকে।