রাশিয়ার ‘নিষ্ফলা’ আলাস্কা হয়ে গেল যুক্তরাষ্ট্রের ‘সম্পদ’

‘আলাস্কায় স্বাগত’
ছবি: উইকিপিডিয়া কমনস

১৮ অক্টোবর ১৮৬৭। আলাস্কার সিকটা শহরের গভর্নর হাউজের সামনে চলছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সেনাবাহিনীর যৌথ কুচকাওয়াজ। রণবাদ্যের তালে তালে নেমে যাচ্ছে রুশ সাম্রাজ্যের রাজকীয় পতাকা, একইসঙ্গে ওপরে উঠছে যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা। এর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার আলাস্কা অঞ্চল হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের। আয়তনে বাংলাদেশ থেকে ১২ গুণ বড় এই সমৃদ্ধ অঞ্চলটিকে মাত্র ৭২ লাখ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল রাশিয়া!

যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের একটা বড় অংশ আলাস্কা কিনে নেওয়ার বিরোধিতা করেছিল
ছবি: পেক্সেলস

১৮৫৩ সাল থেকে ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত চলা ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ব্রিটেনের নেতৃত্বাধীন মিত্রশক্তির কাছে রাশিয়া পরাজয় বরণ করে। এই যুদ্ধে ৮ লাখ রুশ নাগরিক হতাহত হয় এবং রাশিয়া পঙ্গু হয়ে পড়ে অর্থনৈতিকভাবে। সে সময় রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের বাইরে থাকা জনবিরল আলাস্কা অঞ্চলটিকে বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন রাশিয়ার সম্রাট দ্বিতীয় আলেকজান্ডার। ব্রিটেনের কাছে সম্ভাব্য যুদ্ধে হারানোর চেয়ে তিনি আলাস্কা বিক্রি করে দেওয়াই সমীচীন মনে করেন। তাছাড়া আলাস্কা থেকে রাশিয়া কোনো মুনাফাও করতে পারছিল না, বরং উপনিবেশ টিকিয়ে রাখতে হচ্ছিল ভর্তুকি দিয়ে।

১৮৫৯ সালে রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আলাস্কা বিক্রির প্রস্তাব উত্থাপন করে। তখন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে বৈরিতা ছিল না। দেশ দুটির মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল বিদ্যমান। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া উভয় দেশেরই ছিল ব্রিটেনের সঙ্গে যুদ্ধ করার তিক্ত অভিজ্ঞতা। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আলাস্কা বিক্রি করে ব্রিটেনকে কোণঠাসা করাও ছিল আলাস্কা বিক্রির অন্যতম প্রধান কারণ।

১৯৫৯ সালে আলাস্কাকে আমেরিকার ৪৯তম অঙ্গরাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়
ছবি: উইকিপিডিয়া কমনস

তবে সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে চলছিল গৃহযুদ্ধ। ফলে রাশিয়ার প্রস্তাবে মনোযোগ দেওয়ার মতো সময় মার্কিন-কর্তাদের ছিল না। গৃহযুদ্ধ শেষ হলে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম সিওয়ার্ড আলাস্কা কেনার ব্যাপারে উদ্যোগী হন। বলা হয়, আলাস্কা কেনার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন তিনি। সারা রাত দরকষাকষি শেষে ১৮৬৭ সালের ৩০ মার্চ ভোরে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে প্রায় ১৭ লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের আলাস্কা কিনে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। সে বছর এপ্রিল মাসে সিনেট চুক্তিটি অনুমোদন করে এবং মে মাসে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু জনসন চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের একটা বড় অংশ আলাস্কা কিনে নেওয়ার বিরোধিতা করেছিল। অন্যদিকে রাশিয়ার জনগণ এই বিক্রিকে জানিয়েছিল সাধুবাদ। তবে পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করে তিন দশক পর থেকে। ১৮৯৬ সালে আলাস্কায় সোনার খনি আবিষ্কারের পর থেকে দুই দেশের জনগণের ভুল ভাঙতে শুরু করে। আলাস্কায় একের পর এক স্বর্ণ ও তেলের খনি আবিষ্কৃত হতে থাকে আর রাশিয়ার জনগণের আক্ষেপ বাড়তে থাকে।

১৮৯৮ সালে ‘ক্লনডাইক গোল্ড রাশ’-এর সময় চিলকুট ট্রেইলে স্বর্ণসন্ধানীদের দীর্ঘ সারি
ছবি: উইকিপিডিয়া কমনস

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আলাস্কা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ১৯৫৯ সালে আলাস্কাকে আমেরিকার ৪৯তম অঙ্গরাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আলাস্কা এখন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। দেশটির ২৫ শতাংশ তেল এবং ৫০ শতাংশের বেশি সামুদ্রিক খাবার আসে আলাস্কা থেকে। তাছাড়া আমেরিকার অন্যতম শীর্ষ স্বর্ণ উৎপাদনকারী অঙ্গরাজ্য এই আলাস্কা। সামরিক দিক দিয়েও আলাস্কা যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। যুক্তরাষ্ট্র আলাস্কায় দিন দিন সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে যাচ্ছে, যা রাশিয়ার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বহু আগেই।