রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে অক্টোবর বিপ্লবীরা

১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের সময় ভ্লাদিমির লেনিন
ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়ার জার শাসকদের দীর্ঘদিনের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন, রাশিয়া-জাপান যুদ্ধে পরাজয় ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যর্থতা রাশিয়ার মানুষদের মনে বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা এনে দেয়। তা ছাড়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মারাত্মক খারাপ হওয়ায় অনেক মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়ে ফেলে। ফলে রাশিয়ায় ফরাসি বিপ্লবের অনুরূপ একটি বিপ্লব অনিবার্য হয়ে ওঠে।

১৯১৭ সালের প্রথম দিকে সাধারণ জনতা, কৃষক ও শ্রমিকেরা পুরো রাশিয়ায় ঘটিয়ে দেয় এক ব্যাপক বিপ্লব। তারা রাস্তায় নেমে এসে পেত্রোগ্রাদের দখল নেয়। জনগণের দাবির মুখে সিংহাসন ত্যাগ করতে বাধ্য হন জার দ্বিতীয় নিকোলাস। দেশের প্রগতিশীল ও মধ্যবর্তী শ্রেণির নেতাদের নিয়ে গঠিত হয় ডানপন্থী সরকার। এর মধ্য দিয়ে রুশ বিপ্লবের প্রথম পর্যায়ের সমাপ্তি ঘটে।

তবে এই গণতান্ত্রিক সরকার রাশিয়ার শ্রমিক ও কৃষকদের আস্থা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। ফলে প্রথম বিপ্লবের সাফল্য থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে কিছুদিন পরই শুরু হয় দ্বিতীয় বিপ্লব। ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসে সুইজারল্যান্ড থেকে দেশে ফিরে বিপ্লবের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ভ্লাদিমির লেনিন। দেশে ফিরে তিনি ঘোষণা করেন রাশিয়ায় বুর্জোয়া গণতন্ত্রের কোনো প্রয়োজন নেই, রাশিয়ার সরকার পরিচালিত হবে শ্রমিক ও কৃষকের দ্বারা। এপ্রিল-মে মাসের দিকে রাশিয়ায় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তখন দেশ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় সরকার।

ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বে শুরু হয় বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্যায়। তাঁর নেতৃত্বে কয়েক হাজার সদস্য পুরো রাশিয়ায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর জনগণের সমর্থন নিয়ে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনাগুলোতে হানা দেয় এবং পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে (জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী দিনটি ছিল ২৫ অক্টোবর, সে জন্য এ ঘটনাকে ‘অক্টোবর বিপ্লব’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। লেনিনের কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থকদের বলশেভিক নামে ডাকা হতো। ফলে এই বিপ্লবকে ‘বলশেভিক বিপ্লব’ও বলা হয়ে থাকে)।

বিপ্লব শুরু হওয়ার এক দিন পর (১৯১৭ সালের ৮ নভেম্বর) পেত্রোগাদের উইন্টার প্যালেসের সামনে
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

লেনিন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেন এবং সমাজতান্ত্রিক মতবাদ অনুযায়ী, দেশ পরিচালনা করেন। কিন্তু তিনি প্রথমে শক্ত হাতে দেশ পরিচালনা করতে ব্যর্থ হন। লেনিনের নির্দেশে অনেক বিরোধী নেতাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে তাঁরা সংগঠিত হয়ে বলশেভিকদের চিরশত্রু হিসেবে আবির্ভূত হয়। তাঁরা একজোট হয়ে গঠন করে ‘হোয়াইট আর্মি’। বলশেভিকদের সঙ্গে হোয়াইট আর্মিরা গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

হোয়াইট আর্মিরা সোভিয়েতজুড়ে শুরু করে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড। ১৯১৮ সালে মস্কোতে একটি কারখানা পরিদর্শন করার সময় তাঁরা ভ্লাদিমির লেনিনকে হত্যাচেষ্টা করে। সে যাত্রায় বেঁচে যান তিনি। কিন্তু লেনিনের অনুসারীদের মনে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে। এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে এবং হোয়াইট আর্মিকে দমন করার লক্ষ্যে বলশেভিকরা গঠন করে রেড আর্মি। তারা দেশব্যাপী ত্রাসের রাজত্ব শুরু করে। ইতিহাসে এই ত্রাসের সময়কালকে ‘দ্য রেড টেরর’ বলা হয়ে থাকে।

১৯৮৮ সালে রিগায় অক্টোবর বিপ্লবের বার্ষিকী উদ্‌যাপন
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

বলশেভিকদের কারাগারে বন্দী থাকা ৫১২ জন সমাজতন্ত্রবিরোধী এবং অভিজাত নেতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে তারা হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। এরপর তারা একের পর এক বিরোধী ব্যক্তিদের হত্যা করতে থাকে। তাঁদের এই তালিকায় ছিল জার আমলের উচ্চকক্ষের সংসদ সদস্য, ডানপন্থী সরকারের সাবেক মন্ত্রী এবং ডানপন্থীদের বিভিন্ন স্তরের নেতা। লেনিন নিজে মৃত্যুদণ্ড না দিলেও পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছিলেন। ১৯১৭ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত বলশেভিকরা নির্বিচারে প্রায় ২০ লাখ মানুষ হত্যা করে। হোয়াইট আর্মিকে নির্মূল করে দেওয়ার মাধ্যমে শেষ হয় এই হত্যাযজ্ঞ।