ব্যাঙের বিয়ের আয়োজন থেকে কারাগারে

আঁকা: জুনায়েদ

গরমে চরম অবস্থা চারদিকে। ঘেমেনেয়ে একাকার সবাই। আদতে ৩২ ডিগ্রি হলেও ৪৫ ডিগ্রি তাপমাত্রার অনুভূতি দেখাচ্ছে স্মার্টফোনের অ্যাপ। চারদিকে মানুষের হাহাকার। বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করছেন অনেকেই। এলাকার বড় ভাই গামছা স্বপন দায়িত্ব নিলেন ব্যাঙের বিয়ে দেবেন। তাতেও যদি বৃষ্টি নামে। গরম দাপট কমায়। তো যেই ভাবা সেই কাজ।

অঞ্জনদার ঘাড়ে পড়েছে বিয়ের আয়োজন করার। কানে কানে বলে রাখি, দাদা নিজেই চিরকুমার! ঘণ্টা যায়, দিন যায়। এদিকে অঞ্জনদার কোনো খবর নেই! খুঁজতে খুঁজতে স্বপন ভাই আরও এক প্রস্থ ঘেমেনেয়ে একাকার। ভাগ্যিস, কাঁধে গামছা থাকে তাঁর। সেই গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে এখন এমন অবস্থা যে দেখলে মনে হয়, গামছাটা বুঝি ভেজা! স্বপন ভাই বললেন, ‘নিজেকে কাপড় শুকানোর হ্যাঙ্গার মনে হচ্ছে রে, আবু!’

অবশেষে অঞ্জনদার দেখা মিলল আরকে মিশন রোডে। স্বপন ভাই তেড়েফুঁড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রে অঞ্জন, খবর কী? কই আছিলি?’

অঞ্জনদা বললেন, ‘আরে ব্যাটা, কমিউনিটি সেন্টারই ভাড়া পাচ্ছি না।’

স্বপন ভাইয়ের পাল্টা প্রশ্ন, ‘কমিউনিটি সেন্টার কেন?’

অঞ্জনদা খেপে উঠলেন, ‘আরে ব্যাটা, তুই–ই তো বললি ব্যাঙের বিয়ের আয়োজন করতে। কমিউনিটি সেন্টার ছাড়া বিয়ে হবে কোথায়? কমিউনিটি সেন্টারের লোকেরা পাত্র-পাত্রী ব্যাঙ শুনলে সোজা বের করে দেয়!’

স্বপন ভাইয়ের মুখে এবার হো হো মার্কা হাসি, ‘এবার বুঝছি, তোর বিয়ে হয় নাই কেন! আরে ব্যাটা, এই বিয়ে তো সেই বিয়ে না। এটা তো আমার যেকোনো হাটে–মাঠে–ঘাটে করতে পারি। ধুর। তোরে দিয়ে আসলে এই কাজ হবে না। আমি নিজেই ব্যবস্থা করছি। চল, লিটনের অফিসে যাই।’

লিটন ভাই বাংলামোটরে এক অফিসে কাজ করেন। তাঁর অফিসে গিয়ে দুজনের চোখ ছানাবড়া। স্বপন ভাই জিজ্ঞেন করেন, ‘কী রে লিটন, তোর অফিসে এসি লাগাইছে? কখন, কবে? জানাইলি না!’

লিটন ভাই নিচু স্বরে বললেন, ‘তোরা তো জানিসই, আমার অফিসের বস কেমন কিপ্টা। বেতন দিতে দিতে ২০ তারিখ পার করে দেয়। কর্মীরা বিরক্ত হয়ে দেয়ালে পোস্টার লাগাল—শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই মজুরি দিয়ে দিতে হয়। বস অফিসে এসে পোস্টার দেখেই এসি লাগানোর ব্যবস্থা করলেন।’

আঁকা: জুনায়েদ

স্বপন ভাই অঞ্জনদার দিকে তাকিয়ে জানতে চান, ‘এটার সাথে ওইটার কী সম্পর্ক?’

লিটন ভাই বলেন, ‘এসি লাগানোর পরদিন একটা পোস্টার আগের পোস্টারের পাশে লাগানোর ব্যবস্থা করলেন বস। তাতে লেখা—এ জন্য অফিসে এসি লাগানো হয়েছে। আশা করি, কেউ ঘামবেন না।’

‘তুই এসিতে থাক, আমরা গেলাম।’ বলেই মিরপুরের তারেক ভাইয়ের বাসার দিকে রওনা দিলেন স্বপন ভাই আর অঞ্জনদা। তারেক ভাই শৌখিন ফটোগ্রাফার। সারা বছর থ্রি–কোয়ার্টার প্যান্ট পরেন। এ লাইনটা অবশ্য একটু বাড়িয়ে বলা। কারণ, শীতের দিনে ফুলপ্যান্ট ছাড়া উপায় থাকে না। স্বপন ভাইয়েরা তারেক ভাইকে অনুরোধ করলেন, ‘আমরা ব্যাঙের বিয়ে দেব। তুমি ওয়েডিং ফটোশুটটা করে দাও।’

তারেক ভাই বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘কোন আক্কেলে আমাকে ওয়েডিং ফটোশুট করতে বলেন? আমার এ বিষয়ে আগ্রহ নাই দেখেই না আমি এখনো ব্যাচেলর!’

এতটুকু বলে অঞ্জনদার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার মাথায় চুল নাই ঠিক আছে, তাই বলে আক্কেলও নাই?’

স্বপন ভাই ফোড়ন কাটলেন, ‘আক্কেল থাকলে তো এত দিন ব্যাচেলর থাকত না।’

তারেক ভাই আরও গরম হয়ে বললেন, ‘একই ব্যাপার আমার বেলায় ঘটে নাই। আমার মাথাভর্তি চুল আর নিচে মগজও আছে।’

পরিস্থিতি গরম থেকে উত্তপ্ত হয়ে উঠল। তারেক ভাই তাঁর রুমের এসি বন্ধ করে দিলেন। গরমে ঘামতে ঘামতে স্বপন ভাই, অঞ্জনদা আর থাকতে না পেরে বের হয়ে গেলেন।

গলিতে কেউ আর কোনো কথা বললেন না। মেইন রোডে আল হেলাল হাসপাতালের সামনে এসে মেজাজ গরম করে হাঁটা দিলেন স্বপন ভাই। ভাবলেন একা একা চলে যাবেন। কিন্তু পকেটে হাত দিয়ে দেখেন, মেজাজ যেমন গরম, পকেট তেমন ঠান্ডা। তারপর আস্তে করে অঞ্জনদার পাশে গিয়ে বললেন, ‘চল, যাইগা। গাড়িভাড়া তুই দিস।’

বাস রোকেয়া সরণি দিয়ে এগোনোর সময় হঠাৎ স্বপন ভাইয়ের চিৎকার, ‘পাইছি কাকা, পাইছি!’

আঁকা: জুনায়েদ

অঞ্জনদা জানতে চান, ‘কী পাইছিস?’

স্বপন ভাই আর বলেন না তিনি কী পেয়েছেন।

কদিন পর পত্রিকায় ছবিসহ খবর দেখে সবাই অবাক। এ তো আমাদের স্বপন ভাই। গামছা স্বপন। খবরটা বিস্তারিত পড়ে জানা গেল, ঢাকার বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম বুথে অযথা ঘোরাঘুরির কারণে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক হয়েছেন তিনি।

লোকে অনেক কথাই বলাবলি করছে। তবে আমরা তো জানি, স্বপন ভাই ওই এটিএম বুথগুলোতে অহেতুক ঘোরাঘুরি করতেন না। বুথের ভেতরে এসির হাওয়া খেতেই যেতেন তিনি। গরম থেকে বাঁচতে গিয়ে বেচারা এখন না জানি কেমন উত্তপ্ত আবহাওয়ায় দিনাতিপাত করছেন!