আরেকটি পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্ত থেকে যেভাবে ফিরে এসেছিল পৃথিবী

মস্কোর রেড স্কয়ারে মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়েছে। এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষভাবে অংশ না নিলেও ইউক্রেনকে সহায়তা করে যাচ্ছে সমরাস্ত্র দিয়ে। ফলে রাশিয়ার এ হুমকি যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। ৬ অক্টোবর ডেমোক্রেটিক পার্টির এক অনুষ্ঠানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বর্তমান পরিস্থিতিকে কিউবার মিসাইল সংকটের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি বলেন, ‘কিউবার মিসাইল সংকটের পর থেকে আমরা এ ধরনের পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কার মুখোমুখি হইনি।’

বাঁ থেকে জন এফ কেনেডি, ফিদেল কাস্ত্রো ও নিকিতা ক্রুশ্চেভ
ছবি: সংগৃহীত

১৯৫৯ সালে কিউবায় সমাজতান্ত্রিক নেতা ফিদেল কাস্ত্রো ক্ষমতায় এসে রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। সমাজতন্ত্রবিরোধী যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাদের মূল ভূখণ্ড থেকে মাত্র ৯০ মাইল দূরে অবস্থিত কিউবার এ অবস্থান মেনে নিতে পারছিল না। ফলে ফিদেল কাস্ত্রো সরকারকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র নানামুখী তৎপরতা শুরু করে। একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র কিউবায় আক্রমণের উদ্যোগ নিলে কিউবা সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য চায়। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় গোপনে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র পাঠায় এবং ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণকেন্দ্র স্থাপন করে।

কিউবা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব (নটিক্যাল মাইলে)

১৯৬২ সালের আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গোয়েন্দা প্রতিবেদন আসতে থাকে যে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করছে। ইউ-২ গুপ্তচর বিমানের নজরদারি এবং কিউবার আকাশে স্যাটেলাইট স্থাপন করেও পর্যাপ্ত তথ্য পাচ্ছিল না যুক্তরাষ্ট্র। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী কিউবার উপকূলে একটি সোভিয়েত জাহাজের ছবি তুলতে সক্ষম হয়। এরপর ১৪ অক্টোবর মার্কিন বিমানবাহিনীর অধীন আবারও ইউ-২ গুপ্তচর বিমান ওড়ানো হয় এবং এই বিমানের মাধ্যমে তোলা ছবিতে স্পষ্ট দেখা যায়, কিউবার পশ্চিমাঞ্চলে ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের জন্য প্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণকাজ চলছে। দুই দিন ধরে ছবিগুলো বিশ্লেষণ করা হয় এবং ১৬ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট কেনেডির সামনে ছবি এবং তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়। প্রেসিডেন্ট কেনেডি তাঁর উপদেষ্টাদের এক জরুরি সভায় ডাকেন। সভায় অধিকাংশ উপদেষ্টা কিউবায় আক্রমণের পক্ষে মত দিলেও কেনেডি আক্রমণের জন্য আরও সময় নিতে চান।

এক্সিকিউটিভ কমিটি অব দ্য ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সভায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি ও প্রতিরক্ষা সচিব ম্যাকনামারা
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

২২ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট কেনেডি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। ওই ভাষণে তিনি কিউবায় সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান এবং বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রতি ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় মাত্রার সামরিক সতর্কতা জারি করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এ ভাষণে সারা বিশ্বের মানুষ আরও একটি পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা প্রকাশ করে এবং সবার সামনে হিরোশিমা ও নাগাসাকির করুণ দৃশ্য ভেসে ওঠে।

২৫ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র কিউবার বিরুদ্ধে নৌ অবরোধ আরোপ করলে রাশিয়া তাদের ১৪টি কিউবাগামী জাহাজ দেশে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। সবচেয়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় ২৬ অক্টোবর। সেদিন সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি সাবমেরিন যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ সীমা অতিক্রম করতে গেলে মার্কিন নৌবাহিনী ‘ডেপথ চার্জ’ নিক্ষেপ করে। মার্কিন নৌবাহিনী জানত না, এই সাবমেরিনে পারমাণবিক টর্পেডো রয়েছে। সাবমেরিনটি পারমাণবিক টর্পেডো নিক্ষেপের জন্য পানির উপরিভাগে উঠে আসে। তবে সাবমেরিনের তিনজন কমান্ডারের একজন টর্পেডো নিক্ষেপের অসম্মতি জানালে আরেকটি পারমাণবিক যুদ্ধ থেকে রক্ষা পায় বিশ্ব। এর কয়েক ঘণ্টা পর সোভিয়েত ইউনিয়ন আকাশে একঝাঁক মিগ ফাইটার বিমান ওড়ায়, জবাবে যুক্তরাষ্ট্র ওড়ায় তাদের এফ-১০২ যুদ্ধবিমান। পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশ তখন সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।

যুক্তরাষ্ট্রের মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল জুপিটার, যা ইতালি ও তুরস্ক থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

একই দিনে কেনেডি জানতে পারেন, কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণকেন্দ্রে কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। তখন তিনি কিউবায় সামরিক হামলার অনুমোদন দেওয়ার কথা বিবেচনা করেন। ঠিক তখন সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী নিকিতা ক্রুশ্চেভ কিউবা আক্রমণ না করার মার্কিন প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণকেন্দ্র সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেন। তবে এর পরদিন ক্রুশ্চেভ তাঁর প্রস্তাবের সঙ্গে তুরস্কে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণকেন্দ্র ভেঙে ফেলার শর্ত যোগ করেন।

যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত সরকারের প্রস্তাব মেনে নিলে ২৮ অক্টোবর বিকেল থেকে কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি ভেঙে ফেলা শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ক থেকে তাদের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সরিয়ে নেয়। মূলত কেনেডি ও ক্রুশ্চেভের কূটনৈতিক দক্ষতার কারণে কিউবার মিসাইল সংকটের সমাধান হয় এবং পৃথিবী একটি পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে আসে।