আঁকাআঁকিতে তীর্থ–যাত্রা

রীশাম শাহাব তীর্থ পেশায় স্থপতি। পেশার গণ্ডির বাইরে ম্যুরাল পেইন্টিং, কার্টুন আর গ্রাফিকস ডিজাইনে খুব অল্প সময়ে নিজের উপস্থিতির জানান দিয়েছেন। সম্প্রতি রাজধানীর নিকুঞ্জ লেক পার্কে শেষ করেছেন ‘অভ্যুত্থান’ নামে একটি ম্যুরালের কাজ। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ—বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো উঠে এসেছে তাঁর এই ম্যুরালে। এ ছাড়া দেশি-বিদেশি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের জন্য বাণিজ্যিকভাবে ম্যুরাল এঁকেছেন। বইয়ের প্রচ্ছদ–অলংকরণ এবং কার্টুন আঁকছেন নিয়মিত। কাজগুলো প্রশংসিত হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তরুণ এই শিল্পীর সঙ্গে কথা হলো আমাদের...

সম্প্রতি শেষ করা ম্যুরাল ‘অভ্যুত্থান’–এর সামনে রীশাম শাহাব তীর্থ
খালেদ সরকার

প্রশ্ন :

কবে থেকে ম্যুরাল পেইন্টিংয়ের কাজ শুরু করলেন?

ছোটবেলা থেকেই আমি ছবি আঁকতাম। তবে ম্যুরাল পেইন্টিংয়ের কাজ শুরু করেছি বছর তিনেক আগে থেকে।

প্রশ্ন :

আপনার কাজের প্রক্রিয়াটি কেমন? সংক্ষেপে যদি বলেন...

মূলত তিন ধাপে কাজটি করা হয়। প্রথমে যে বিষয় নিয়ে কাজ করতে যাচ্ছি, সেটি নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করি। এরপর খসড়া নকশা করি। সেটি ক্লায়েন্টকে দেখাই। তাদের মতামত নিই। চূড়ান্ত ধাপে চিত্রকর্মটি দেয়ালে বসানোর কাজ করা হয়। সরাসরি রংতুলি ব্যবহার করে, স্টিকার প্রিন্ট অথবা সিরামিক ব্যবহার করে দেয়ালে বসানো হয়।

প্রশ্ন :

বাণিজ্যিকভাবে এ ধরনের চিত্রকর্মের ভাবনা কীভাবে এল?

২০১৫ সালের পর থেকে টুকটাক নিজের মতো করে কাজ শুরু করেছিলাম। তার আগে পড়াশোনা আর চাকরির কারণে বাইরে কাজ করার সময় ছিল না। ২০১৭ সালে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিসের দেয়ালে ম্যুরাল পেইন্টিংয়ের কাজ পেয়েছিলাম। ওই কাজের পর থেকেই অনেক বাণিজ্যিক কাজ আসতে শুরু করল।

ইউএল ভিএস বাংলাদেশ লিমিটেড অফিস
সংগৃহীত

প্রশ্ন :

এখন পর্যন্ত কয়টি ম্যুরাল এঁকেছেন?

ছোট–বড় মিলিয়ে প্রায় ১৫টি ম্যুরাল করেছি। উবার, ডমিনোজ পিৎজা, জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনালের মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানের অফিসে ম্যুরাল বানিয়েছি। আবার আমাদের দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), এপেক্স, সেইলরসহ বেশ কয়েকটি দেশি প্রতিষ্ঠানের জন্যও কাজ করেছি।

উবার অফিস
সংগৃহীত
এপেক্স অফিস
সংগৃহীত

প্রশ্ন :

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ধরনের চিত্রকর্ম বেশ জনপ্রিয়, বাংলাদেশে চাহিদা কেমন?

বাংলাদেশেও অনেক বছর ধরেই ম্যুরালের প্রচলন আছে। ঢাকা শহরের অনেক দেয়ালে ম্যুরাল দেখা যায়। রামপুরার টেলিভিশন ভবন, কুর্মিটোলার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, পিলখানার বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদর দপ্তর, শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যালয়ের সামনের ফটকে চমৎকার কিছু ম্যুরাল আছে। তবে সম্প্রতি ঢাকার বিভিন্ন রেস্তোরাঁ ও অফিসগুলোর ভেতরের দেয়ালে ম্যুরালের চল শুরু হয়েছে। ফলে দিন দিন এই চিত্রকর্মের চাহিদা বাড়ছে বলেই আমি মনে করি।

ডমিনোজ পিৎজার দেয়াল
সংগৃহীত

প্রশ্ন :

আপনার অধিকাংশ ম্যুরালের বিষয়বস্তু হিসেবে ঢাকা শহর প্রাধান্য পেয়েছে। নিকুঞ্জ লেক পার্কের ‘অভ্যুত্থান’ কাজটিতে অবশ্য ইতিহাস উঠে এসেছে। তো ঢাকার প্রাধান্য কী কারণে?

ঢাকা আমার অনেক প্রিয় শহর। ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, উৎসব, মানুষের জীবনযাত্রা—এসব নিয়ে আমার বেশ আগ্রহ আছে। এ–সংক্রান্ত অনেক বইও আমি পড়েছি। তাই আমি সব সময় আমার কাজের মধ্যে ঢাকা শহরকে যেকোনোভাবে স্থান দেওয়ার চেষ্টা করি।

আর্কএশিয়ার প্রদর্শনীতে কন্টেইনারের গায়ে ম্যুরাল
সংগৃহীত

প্রশ্ন :

গত বছর আর্কএশিয়ার (এশিয়ার স্থপতিদের নিয়ে গড়ে ওঠা ‘আর্কএশিয়া ফোরাম’-এর ২০তম আন্তর্জাতিক সম্মেলন) প্রদর্শনীতে কনটেইনারের গায়ে আপনার চিত্রকর্ম ছিল। ওই প্রদর্শনীর অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

মাত্র সাত দিনের মধ্যে পুরো প্রদর্শনীর কাজ শেষ করতে হয়েছিল। রাতদিন কাজ করেছি সে সময়। ওই প্রদর্শনীতে ১২টি কনটেইনার ভাড়া করেছিলাম আমরা। কনটেইনারগুলোর বাইরের ম্যুরাল করার দায়িত্ব ছিল আমার কাঁধে। ৬টি কনটেইনারের গায়ে তুলে ধরেছিলাম আমাদের ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য। আর বাকি ৬টিতে ছিল ঢাকা শহরের গল্প। চলতিপথে মানুষ গাড়ি থামিয়ে আমার চিত্রকর্ম দেখত—সে দৃশ্য সত্যিই অনেক ভালো লাগার।

ছেলেবেলায় যা দেখতে চাইতেন, সেসবই কাজের মধ্যে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন তীর্থ
খালেদ সরকার

প্রশ্ন :

আপনি তো পেশায় স্থপতি। পাশাপাশি ছবি আঁকেন, গ্রাফিকস ডিজাইন করেন, আবার কার্টুনও আঁকেন। এর মধ্যে কোন পরিচয়টি আপনার সবচেয়ে প্রিয়?

অবশ্যই স্থপতি। পেশাগত দিক থেকে আমি স্থপতি পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। স্থাপত্যকলা সম্পর্কে আমার প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান আছে। আর ছবি আঁকা, গ্রাফিকস ডিজাইন—এগুলো আমি নিজে নিজে শিখেছি, প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই। তাই আমি নিজেকে শিল্পী দাবি করি না।

তীর্থর আঁকা ‘কিশোর আলো’র প্রচ্ছদ

প্রশ্ন :

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ক্যাম্পাসে আপনার চিত্রকর্ম আছে। নিজের ক্যাম্পাসে বড় ক্যানভাসে এ ধরনের কাজ করতে পারার অভিজ্ঞতাটা কেমন?

আবরার হত্যার কিছুদিন পর আমাকে ওই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ওই ঘটনার পর ক্যাম্পাস বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিল। শিক্ষার্থীরাও একধরনের মানসিক ট্রমার মধ্যে ছিলেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এমন একটা চিত্রকর্ম তৈরি করতে, যা শিক্ষার্থীদের মানসিক অস্থিরতা কাটিয়ে নতুন একটা পরিবেশে আমন্ত্রণ জানাবে। তাই এই কাজের অভিজ্ঞতা একেবারেই অন্য রকম। এখন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ওই ম্যুরালের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন। অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও অনেকে সেখানে গিয়ে ছবি তোলেন। ছবিগুলো দেখে ভালোই লাগে। যদিও এটি পুরকৌশল বিভাগের জন্য করেছিলাম। নিজের বিভাগের (স্থাপত্যকলা) জন্য কাজ করতে পারলে নিশ্চয়ই আরও ভালো লাগবে।

বুয়েট ক্যাম্পাসে তীর্থর চিত্রকর্ম
সংগৃহীত
তীর্থর আঁকা করোনাকালের কার্টুন

প্রশ্ন :

সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আপনি কার্টুন আঁকেন। অধিকাংশই প্রতিবাদধর্মী এবং বেশ কিছু কার্টুন ভাইরাল হয়েছে। কার্টুন নিয়ে আপনার ভাবনা কী?

প্রতিবাদ নয়, এগুলো নিতান্তই সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার প্রতিক্রিয়া। আমি প্রতিবাদ করার মতো ধৃষ্টতা দেখাতে চাই না। সমসাময়িক বিষয়গুলোতে শুধু নিজের মতো করে প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য কার্টুন বেছে নিয়েছি। এগুলো ভাইরাল হলো কি না, তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।

চিরকালীন বিষয়
করোনাকালে পয়লা বৈশাখের এই কার্টুন ঝড়ের বেগেই ভাইরাল হয়েছিল

প্রশ্ন :

আপনি নিয়মিত বইয়ের প্রচ্ছদ–অলংকরণ করছেন। ইংরেজি ভাষার বইয়েরও প্রচ্ছদ–অলংকরণ করেছেন। ‘বাবুইবেলা’ নামে নিজের একটি বই আছে। শিশুদের জন্য করা এই কাজগুলো নিয়ে আপনার বক্তব্য জানতে চাই...

শিশুদের জন্য কাজ করতে সব সময় আনন্দ পাই। যত দিন সুযোগ পাব, শিশুদের নিয়ে কাজ করে যাব। কারণ, শিশুদের জগৎটা অনেক রঙিন। ওদের মধ্যে কলুষিত বিষয়গুলো নেই। ওদের চিন্তাভাবনাও অনেক মজার। আমি ছেলেবেলায় যা পড়তে চাইতাম, যা দেখতে চাইতাম, সেগুলোই আমার বর্তমান কাজের মধ্যে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি। আর ‘বাবুইবেলা’ বইটি লিখেছি আমার মেয়ে পৃথিবীতে আসার পর। আমাদের মা–বাবা হওয়ার নতুন এক অভিজ্ঞতার কথা লিখেছি সেখানে। এটা শিশুতোষ বই হলেও যাঁরা সদ্য মা–বাবা হয়েছেন, তাঁরা ওতে নিজেদের খুঁজে পাবেন বলে আমি করি।

তীর্থর আঁকা বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ

প্রশ্ন :

আপনার প্রিয় কাজ কী? শখ কী? প্রিয় অভিনয়শিল্পী, সংগীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী এবং স্থপতির নাম জানতে চাই।

দৈনন্দিন কাজের বাইরে আসলে শখের কাজ করার সময় হয়ে ওঠে না। তবে সুযোগ পেলে সিনেমা দেখি, গান শুনি আর বই পড়ি। সাদাকালো সিনেমা বেশি দেখা হয়। নজরুলগীতি আমার দারুণ লাগে। আর বইয়ের মধ্যে বাংলা বই বেশি পড়া হয়। চিত্রশিল্পীদের মধ্যে কাইয়ুম চৌধুরী ও রফিকুন নবীর ভক্ত আমি। স্থপতিদের মধ্যে কাশেফ মাহবুব চৌধুরীর কাজ আমার অনেক প্রিয়।

নিজের আঁকায় স্ত্রী–সন্তানসহ তীর্থ