আজাইড়া বা আজাড়ে থেকে এসেছে আষাঢ়ে গল্প?

শব্দের রয়েছে বিচিত্র রকম অর্থ, বিচিত্র রকম প্রয়োগ। তবে অনেক অর্থ, অনেক প্রয়োগ অভিধান সমর্থন করে না। শব্দের উৎস, অর্থ আর প্রয়োগবৈচিত্র্য নিয়ে আমাদের এ আয়োজন...

আঁকা: জুনায়েদ

বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় পানি জমে গেছে। ভেজা জামাকাপড় আর আধাবন্ধ ছাতা নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে অফিসে ঢুকলেন সৈয়দ ঘণ্টন। এ রকম বৃষ্টির মধ্যে অফিসে আসতে বরাবরই সবার দেরি হয়ে যায়। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, তাঁর তলায় যাঁরা কাজ করেন, সবাই চলে এসেছেন। শুধু এসেছেন তা-ই নয়, বক্কর সাহেবের টেবিল ঘিরে খোশগল্পে মেতেছেন।

সৈয়দ ঘণ্টন বিষয়টা দ্রুত বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিছু বলার আগেই বক্কর সাহেব চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘এই যে ঘণ্টন সাহেব, চলে আসুন! একটা চেয়ার নিয়ে আপনিও বসে পড়ুন। আষাঢ়ের বৃষ্টিতে সবাই মিলে আষাঢ়ে গল্প করছি।’

পায়ের জুতো জোড়া মারাত্মকভাবে ভিজে গেছে। সে দুটি খুলে এক পাশে রাখলেন সৈয়দ ঘণ্টন। তারপর সোজা চলে গেলেন ওয়াশরুমে। জামাকাপড় ভিজবে, এটা আগেই অনুমান করে তিনি বাড়তি কাপড় ব্যাগে করে নিয়ে এসেছিলেন। মাথা আর গা মুছে শুকনা কাপড় পরে নিলেন। তারপর আয়নায় চুলটা একটু ঠিক করে বক্কর সাহেবের টেবিলে যোগ দিলেন। ঘণ্টন সাহেবের দিকে তাকিয়ে বক্কর সাহেব বললেন, ‘একি! আপনি দেখি ভোজবাজির মতো বদলে গেলেন! ছিলেন ভেজা, হয়ে গেলেন শুকনা।’

বক্কর সাহেবের কথার সূত্র ধরে সবাই তাকালেন সৈয়দ ঘণ্টনের দিকে। সৈয়দ ঘণ্টন অবশ্য শুকনা-ভেজার প্রসঙ্গে না গিয়ে বললেন, ‘আষাঢ়ে গল্প নিয়ে কী যেন বলছিলেন?’

বক্কর সাহেব বললেন, ‘বলছিলাম, আষাঢ় তো শুরু হয়ে গেল। ঝুম বৃষ্টিও নেমেছে। কাজকর্ম নেই। তাই সবাই মিলে আষাঢ়ে গল্প করছিলাম।’

সৈয়দ ঘণ্টন রহস্য করে বললেন, ‘কেন, ভাদ্রের গরমে আষাঢ়ে গল্প করা যাবে না?’

বক্কর সাহেব জবাব দেওয়ার আগেই বজলুল সাহেব বললেন, ‘আপনি তো জানেনই, আষাঢ়ে গল্প মানে আজগুবি গল্প। আষাঢ় মাসে প্রচুর বৃষ্টি হয়। তখন বাইরে যাওয়ার উপায় থাকে না...।’

‘...আর ওই অবসরে সবাই মিলে ঘরে বসে আজগুবি গল্প করে। একে আষাঢ়ে গল্প বলে।’ আরেকজন কথাটা শেষ করলেন।

সৈয়দ ঘণ্টন একটু হেসে নিলেন। বললেন, ‘এমন কথা তো সবাই জানে। তবে আপনারা চাইলে নতুন আরেকটা কথা আমি শোনাতে পারি।’

সৈয়দ ঘণ্টনের কথায় কেউ খুব বেশি অবাক হলেন না। কারণ, সবাই জানেন, তিনি বই ঘেঁটে ঘেঁটে অনেক অজানা তথ্য সবার সামনে হাজির করেন। আর এই ঘাঁটাঘাঁটি থেকেই তাঁর নাম হয়েছে সৈয়দ ঘণ্টন। তিনি বলতে থাকেন, ‘প্রমথ চৌধুরীর নাম তো শুনেছেন। তিনি মনে করেন, আষাঢ়ে শব্দটির সঙ্গে আষাঢ় মাসের কোনো সম্বন্ধ নেই। বরং, আজাড় বা আজাড়ে থেকে আষাঢ়ে শব্দটি এসেছে।’

কোলাজ: একটু থামুন

‘আজাড়ে মানে কী? এ শব্দ তো আগে শুনিনি!’ কেউ একজন বললেন।

‘আজাড়ে শোনেননি। আজাইড়া শুনেছেন তো?’ সৈয়দ ঘণ্টন বলতে থাকলেন, এই আজাড়ে বা আজাইড়া শব্দটি বাংলা ভাষায় এসেছে ফারসি থেকে। এর অর্থ নিরর্থক, বেহুদা। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র আঞ্চলিক ভাষার অভিধানেও আজাড়ে বা আজাইড়া শব্দ আছে। বাংলা ভাষায় এটি এখন আঞ্চলিক শব্দ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।’

বক্কর সাহেব পানের ডিব্বা থেকে একটা পান বের করলেন। খানিক সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজাড়ে বা আজাইড়া থেকে আষাঢ়ে শব্দটি এসেছে। এই তো?’

‘ঠিক তাই। আজাড়ে শব্দটি উচ্চারণ পাল্টে আষাঢ়ে হয়েছে। এর সঙ্গে আষাঢ় মাসের কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন হাসপাতাল শব্দের সঙ্গে হাস আর পাতালের কোনো সম্পর্ক নেই।’

‘হতেও পারে,’ বক্কর সাহেব পান চিবাতে চিবাতে বললেন, ‘আমরা তো হরহামেশা বেহুদা প্যাচালকে বলি আজাইড়া কথা।’

বজলুল সাহেব যোগ করলেন, ‘আমারও মনে হয়, ঘণ্টন সাহেবের কথাই ঠিক। আজাড়ে গল্প বা আজাইড়া গল্প বলতে আজগুবি গল্প বা অবিশ্বাস্য কাহিনি বোঝায়। আষাঢ়ে গল্প বলতেও কিন্তু তা–ই বোঝায়।’

সৈয়দ ঘণ্টন উত্তর দেওয়ার আগে একজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘তবে এখন থেকে আমরা আষাঢ়ে গল্প না বলে আজাড়ে গল্প বলব?’

‘না, তার দরকার নেই।’ সৈয়দ ঘণ্টন উত্তরের সঙ্গে কারণও যোগ করলেন, ‘প্রমথ চৌধুরীর মন্তব্য বেশির ভাগ মানুষের জানা নেই। আর যাঁরা জানেন, তাঁরাও আষাঢ়ে গল্পের এ ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারেন না।’

‘যদি প্রমথ চৌধুরীর কথা ঠিক হয়?’ একজনের জিজ্ঞাসায় খানিক কৌতূহল।

আঁকা: জুনায়েদ

‘ঠিক হলেও মনে রাখবেন, শব্দের উচ্চারণ বদলে যাওয়া ভাষার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বদলে যাওয়া বহুল প্রচলিত শব্দের উচ্চারণ আবার আগের মতো করার দরকার হয় না।’ ঘণ্টন সাহেব ব্যাখ্যা দিলেন।

‘তাহলে আষাঢ়ে গল্পের সঙ্গে যেহেতু আষাঢ় মাসের কোনো সম্পর্ক নেই, এমনকি ভাদ্র মাসেও যেহেতু আষাঢ়ে গল্প হতে পারে, অতএব এখনকার মতো আমরা আজাড়ে গল্প থামাতে পারি।’ বজলুল সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন।

অন্যরাও যাঁর যাঁর জায়গায় যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। সৈয়দ ঘণ্টন দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন, চারদিক ঝলসে দিয়ে রোদ উঠেছে।

তারিক মনজুর: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক

আরও পড়ুন