আপনি যাকে যেভাবে দেখেন

বীরবল কোনো কল্পিত নয়, ঐতিহাসিক চরিত্র। সম্রাট আকবর ও বীরবল ছিলেন হরিহর আত্মা। আবার কোনো কোনো বিষয় নিয়ে দুজনের মধ্যে যে কখনো মনোমালিন্য হয়নি, এমন নয়। হয়েছে। কিন্তু সে শুধু সাময়িকসময়ের জন্য। কারণ, রাজকাজ পরিচালনায় সম্রাট আকবরের কাছে বীরবল ছিলেন এক অনিবার্য মন্ত্রণাদাতা।

অলংকরণ: শামীম আহমেদ

রাজ্যের লোকেরা তাঁর সম্বন্ধে কী ধারণা পোষণ করে, সেটা দেখার জন্য একদিন বাদশাহ আকবর বীরবলকে সঙ্গে নিয়ে ছদ্মবেশে রাজপথে বেরোলেন। রাজপথ ছাড়িয়ে গ্রামের পথ পেরিয়ে ক্রমশ তাঁরা জঙ্গলের পথ ধরে এগিয়ে চললেন। পথে এক কাঠুরিয়াকে জঙ্গলের দিকে যেতে দেখে আকবর বীরবলকে বললেন, ‘লোকটার সাহস তো খুব। আমার অনুমতি ছাড়াই সে জঙ্গলে কাঠ কাটে!’

আকবর মনে মনে ক্রুদ্ধ হলেন কাঠুরিয়ার প্রতি, কিন্তু মনের ভাব গোপন করে কাঠুরিয়াকে ডেকে বললেন, ‘তুমি কি জানো না, যাঁর জঙ্গল থেকে তুমি কাঠ চুরি করছ, সেই বাদশাহ আকবর আজ মারা গেছেন।’

কাঠুরিয়া কুঠার তুলে ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে মহা আনন্দে বলল, ‘বাদশাহ মারা যাওয়ায় আমাদের মতো গরিবদের খুবই ভালো হলো। আকবর আমাদের শত্রু ছিল। তার কড়া শাসনে আমাদের কষ্টের সীমা ছিল না। বাদশাহ মরল, ভালোই হলো। পৃথিবীর এক পাপিষ্ঠ বিদায় হলো।’

কাঠুরিয়ার কথা শুনে গম্ভীর হয়ে গেল আকবরের মুখ। তিনি কোনো কথা না বলে বীরবলকে নিয়ে জঙ্গলের পথে পা চালালেন। দূরে তাঁর নজরে পড়ল এক বুড়ি মাথায় ঘাসের বোঝা চাপিয়ে এগিয়ে আসছে।

আকবর এবার বীরবলকে নিয়ে রাজপ্রাসাদের দিকে রওনা হলেন। পথে বীরবলকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার বলো তো, দুজন লোক আমার সম্পর্কে দুরকম কথা বলল! আমার আচরণের মধ্যে কি সামঞ্জস্য নেই?’

বুড়ির ওপর আকবরের খুব মায়া হলো। তিনি বীরবলকে বললেন, ‘দুবেলা খাবার জোগাড় করতে এই বুড়ির সারা দিন কী পরিশ্রমটাই না করতে হয়! কোমরটা তার বেঁকে গেছে। খেটে খাওয়া এসব অসহায় বয়সী নারীদের জন্য আমি রাজ তহবিল থেকে মাসোহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করব। এটা আমার কর্তব্য।’

দেশের বাদশাহ সম্বন্ধে এই বুড়ি কী ভাবে, তা জানার জন্য আকবরের ভীষণ কৌতূহল হলো। তিনি বুড়িকে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘তুমি কি জানো না, বাদশাহ আকবর আজ বিষধর সাপের ছোবলে মারা গেছেন।’

মাথার ঝুড়ি পায়ে ফেলে দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল বুড়ি, ‘আমাদের কী সর্বনাশ হলো গো! আমাদের বাদশাহ যে আর আমাদের মধ্যে নেই। কী হবে গো! তাঁর মতো দয়ালু বাদশাহ আর হবে না। কত দানধ্যান তিনি করতেন। আমাদের মতো গরিবদের জন্য তাঁর দয়ার সীমা ছিল না।’

আকবর এবার বীরবলকে নিয়ে রাজপ্রাসাদের দিকে রওনা হলেন। পথে বীরবলকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার বলো তো, দুজন লোক আমার সম্পর্কে দুরকম কথা বলল! আমার আচরণের মধ্যে কি সামঞ্জস্য নেই?’

বীরবল উত্তর দিলেন, ‘জাহাঁপনা, আপনি যাকে যে দৃষ্টিতে দখবেন, সে–ও আপনাকে একই দৃষ্টিতে দেখবে, অর্থাৎ আপনি যার ব্যাপারে খারাপ মনোভাব পোষণ করবেন, সে আপনাকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখবে আর যাকে আপনি ভালো চোখে দেখবেন, সে–ও আপনাকে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখবে।’

আপন কাজের ফল উপলব্ধি করে আকবর অভিভূত হয়ে বীরবলের পিঠ চাপড়ে দিলেন।