ইজ্জতের দর

১৪ এপ্রিল, পয়লা বৈশাখে প্রয়াত হলেন বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ও বর্তমান সভাপতি, লোকসংস্কৃতিবিদ শামসুজ্জামান খান। লোক সংস্কৃতি ও পল্লীসাহিত্য নিয়ে তাঁর বিপুল গবেষণার ফলে আমরা জেনেছি আমাদের শিকড়ের গল্পগাথা। তাঁর সংকলিত এবং পুনর্কথিত ঢাকাই রঙ্গরসিকতা, গ্রামবাংলার রঙ্গগল্পগ্রামবাংলার রঙ্গরসিকতা বইগুলো আমাদের একান্ত নিজস্ব রসিকতার অন্যতম দলিল। এখানে পড়ুন শামসুজ্জামান খানের পুনর্কথিত দুটি গল্প...

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ইজ্জতের দর

এক দরিদ্র মায়ের ছেলে মহাবিদ্বান হয়ে দেশের বাড়িতে ফিরে এল। মা তো দারুণ খুশি। ছেলে বিদ্বান-পণ্ডিত, ভালো চাকরিও করে। ছেলেকে আদর-যত্ন করে মা বললেন, ‘বাজান, বাজারে যাও, মিষ্টি আনো, আমি গেরামের মাইনসেরে মিঠামুখ করামু।’

ছেলে বাজারে যাচ্ছে মিষ্টি কিনতে। পথিমধ্যে তার সঙ্গে দেখা হলো এক ঝুনা বুড়ির।

বুড়ি বলল, ‘বাপ রে, তুমি কই যাও?’

বিদ্বান: বাজারে যাই।

বুড়ি: তয় ভালা কাম অইছে। বাজার থেইকা ইজ্জতের দর জাইনা আইয়ো। ফিরনের সময় আমার বাড়িত খবরডা দিয়া যাইয়ো।

বুড়ির কথায় মহামুশকিলে পড়ল বিদ্বান। ইজ্জতের আবার দরদাম থাকে নাকি? তবে এ বিষয়ে অজ্ঞতার পরিচয় দেওয়াও তার মতো বিদ্বানের পক্ষে মানানসই নয়। সে যে পণ্ডিত! তাই অথই সাগরে পড়ে একটু কূলকিনারা পাওয়ার আশায় সে বলল, ‘তোমার বাড়ি কই, বুড়ি?’

বুড়ি: ইটের ওপরে ইটখলা

তার ওপারে মধুখলা

তার ধারে কোবাকোবি

তার লগে বাড়ির ওপর বাড়ি

মোর বাড়ি তার দক্ষিণের বাড়ি।

বিদ্বান এবার পড়ল আরও ফাঁপড়ে। এর মাথামুণ্ডু তো কিছুই বোঝে না। তাই একটু আশার আলো পেতে এবার সে বলে, ‘তোমরা জাতে কী?’

ফোকলা দাঁতে হেসে হেসে বুড়ি বলে: আইতে অ মারে, যাইতে অ মারে, এমনে অ মারে হেমনে অ মারে।

বিদ্বান-পণ্ডিত ছেলেটি এসবের কিছুই বুঝতে পারে না। বাড়ি ফিরে আসে সে। মাকে খুলে বলে সব কথা।

মা হেসে বলেন, ‘বাজান রে, খালি এলেম দিয়া কাম অয় না, হেলেমও লাগে। ইজ্জত রক্ষা করে কাপড়ে। বুড়ি বাজারে কাপড়ের দর কত, তা-ই জানতে কইছে। “ইটের ওপরে ইট” মানে কুমারবাড়ি—হাঁড়িপাতিল একটার ওপরে আরেকটার পাঁজা কইরা রাখে কুমারবাড়িতে। আখের কলে আখ পিষে মিষ্টি রস বাইর করে, তাই হেই জায়গা অইল “মধুখলা”। আর “কোবাকোবি” অইল কাঠ ফাঁড়নের কল। কলে দিবার আগে কাঠ কোপাইয়া সাইজ কইরা লয়। “বাড়ির ওপর বাড়ি” মানে কামারশালা। দক্ষিণের বাড়িটাই বুড়ির। আর বুড়ি জাতে জোলা। তাঁত চালাইলে মাকু একবার ডাইনে যায়, আবার বামে ফিরে আসে। তাইতে ঠক ঠক শব্দ অয়। আমরা কইলে বেজার অয়, তাই আমরা “নাইল ঢক্কর”ও বলি। বাপ রে, খালি বড় বড় কিতাবেই বিদ্যা নাই। চোখ-কান খোলা রাইখা চলাফিরা করো, হেলেম অইব। সাধারণ বুদ্ধি ও দুনিয়ার জ্ঞান অইব।’

বামুন পণ্ডিত

বহুদিনের কথা। তখন আধুনিক স্কুল-কলেজ এখনকার মতো এতটা বেশুমার হয়নি। সংস্কৃত পড়ার জন্য টোল আর ফারসি পড়ার জন্য মাদ্রাসা—এই-ই ছিল। স্কুল-কলেজ খুঁজে পাওয়া সে সময় অত সহজ ছিল না।

সংস্কৃত পড়ার টোলের পণ্ডিত এবং ফারসি পড়ার মাদ্রাসার মৌলভিদের ধর্ম-কর্মের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন মানুষেরা। হিন্দুরা নেমন্তন্ন করে খাওয়াতেন সংস্কৃত পণ্ডিত বা বামুন-পুরুতকে। বলা ভালো, তাঁরা খেতেও পারতেন মেলা। খাওয়ার শেষ দিকটায় হতো প্রতিযোগিতা। যেমন পুরুত মশাইয়ের গলা পর্যন্ত খাবার উঠে গেছে—এমন অবস্থায় নিমন্ত্রণকর্তা হয়তো বললেন, পুরুত মশাই আরেকটা রসগোল্লা খেতে পারলে আপনাকে আরও এক টাকা বেশি দেব। টাকার লোভে তিনি খেতেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন হতো যে পুরুত-বামুন আর হেঁটে বাড়ি ফিরতে পারতেন না। বাঁশের তৈরি সাইংয়ে করে তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হতো। মৌলভি-মাওলানাদের মধ্যেও কেউ কেউ ছিলেন এমন।

তো, একবার এক শিক্ষিতা ও সুচতুরা হিন্দু বিধবা ভাবলেন, বামুন-পুরুতেরা খাবার নিয়ে বড় অরুচিকর বাড়াবাড়ি করেন। তাই তাঁদের নেমন্তন্ন না করে সংস্কৃত টোলের দুজন পণ্ডিতকে নেমন্তন্ন করবেন। দুজন বিদ্বান খাবেন, দুটো জ্ঞানের কথা বলবেন, সে ভারি শোভন হবে।

যেমন ভাবা তেমন কাজ।

দুই পণ্ডিতকে নেমন্তন্ন করে বাড়িতে আনলেন তিনি। সমাদর করে বসালেন। অনুরোধ করলেন হাতমুখ ধুয়ে আহারে বসতে। জলের ঘটি নিয়ে বাইরে গেলেন এক পণ্ডিত। সে সময় যিনি ঘরে ছিলেন, তিনি আরেক পণ্ডিত। বিধবাকে তিনি বললেন, ‘মা ঠাকরান, পণ্ডিতজনকে নেমন্তন করে খাওয়ানো পুণ্যের কাজ! কিন্তু আপনি ওই ছাগলটাকে নেমন্তন করেছেন কেন?’

ইতিমধ্যে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকেছেন বাইরে থাকা পণ্ডিত। আর ঘরের পণ্ডিত বাইরে গেছেন হাতমুখ ধুতে। সদ্য হাতমুখ ধুয়ে আসা পণ্ডিত তখন ভদ্রমহিলাকে বললেন, ‘মা জননী, আপনার মঙ্গল হোক। আপনার স্বর্গীয় স্বামীর কল্যাণ হোক। তা, আমাকে নেমন্তন্ন করায় আপনার উদ্দেশ্যকে আমি সাধুবাদ দিই। তবে ওই গাধাটাকে কেন নেমন্তন্ন করেছেন, মা ঠাকরান?’

বিধবা ভদ্রমহিলা এবার ভেতরের ঘরে গেলেন। যাওয়ার আগে তাঁদের বলে গেলেন, ‘আপনারা বসুন। আপনাদের খাবার নতুন করে সাজিয়ে আনতে আমার সামান্য একটু বিলম্ব হবে।’

কিছুক্ষণ পর দুটো বড় কাঠের খঞ্চার একটিতে তাজা ঘাস ও অন্যটিতে খড়বিচালি সাজিয়ে দুই পণ্ডিতের সামনে উপস্থিত হলেন বিধবা। বললেন, ‘খান।’

এ ঘটনায় আঁতকে উঠলেন পণ্ডিতদ্বয়, ‘একি! আমাদের এভাবে অপমান করার মানে কী?’

বিধবা বললেন, ‘আমার ওপর ক্রুদ্ধ হবেন না। আপনারাই বলেছেন, আপনাদের একজন ছাগল, আরেকজন গাধা। আমি সেইমতো খাবার দিয়েছি। আমার অপরাধ কোথায়, বলুন?’