দুনিয়া বদলানো ঘটনা
কনফুসিয়াসের শিক্ষা কীভাবে দুনিয়া বদলে দিল
মানবসভ্যতা প্রতিদিন একটু একটু করে বদলে যেতে যেতে আজকের রূপ পেয়েছে। এ বদল চলমান এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু কিছু ঘটনা আছে, যা এক ধাক্কায় সভ্যতাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছিল। সেসব যুগান্তকারী ঘটনা নিয়ে আমাদের এ আয়োজন...
কে না জানেন, কনফুসিয়াস কেবল চীনেরই নন, গোটা পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত দার্শনিক, শিক্ষক ও রাজনীতিবিষয়ক তাত্ত্বিকদের একজন। চীন এবং পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশের সভ্যতা তাঁর দর্শন দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত। আজ থেকে অনেক বছর আগে, খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে কনফুসিয়াস বলেছিলেন, ‘সমাজ ন্যায়সম্মতভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত।’ তখন এই বাক্যই ছিল সম্পূর্ণ নতুন এবং এই ভাবনা ছিল অভিনব।
যা আপনি নিজের জন্য প্রত্যাশা করেন না, তা অন্যের জন্য করবেন না।কনফুসিয়াস, চীনা দার্শনিক (খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫১–৪৭৯)
ধারণা করা হয়, ৫৫১ খ্রিষ্টপূর্বে চীনের জোউ শহরে (এখনকার শ্যানডং) কনফুসিয়াসের জন্ম। বাবার মৃত্যুর সময় কনফুসিয়াসের বয়স তিন বছর। বাবার মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার প্রবল অর্থসংকটে পড়ে। কনফুসিয়াস পরিবারকে সাহায্য করার জন্য কাজে নামেন। কঠোর পরিশ্রমের পরও কনফুসিয়াস পড়ালেখা চালিয়ে যান এবং সরকারি চাকরির কঠিন কঠিন পরীক্ষাগুলোতে উত্তীর্ণ হন।
পথ থেকে পথে
সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার সময় কনফুসিয়াস শাসকদের অন্যায় কাজকর্ম দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান। চাকরির একপর্যায়ে তিনি চীন সরকারের মন্ত্রীও হয়েছিলেন। কিন্তু চাকরিটা ছেড়ে দেন ঘুরে বেড়ানোর জন্য। কেবল শখের বশে যে ঘুরতেন, তা কিন্তু নয়। একটানা ১২ বছর চীনের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়ান কনফুসিয়াস। আর এই পথ থেকে পথে হাঁটার সময় তিনি প্রচার করেন সামাজিক সাম্য সম্পর্কে তাঁর ধারণাগুলো। দীর্ঘ ভ্রমণ থেকে ফিরে আসার পর কনফুসিয়াস তাঁর জীবনের বাকি সময়টা শিক্ষকতা করেই কাটিয়ে দেন।
সুখী হওয়ার উপায়
সুখী জীবনের জন্য কনফুসিয়াসের ছিল খুব সাধারণ কিছু সূত্র। তিনি মনে করতেন, শাসকেরা এমন উদাহরণ সৃষ্টি করবে, যাতে সাধারণ জনগণ একে–অন্যের প্রতি সদাচারে উৎসাহী হবে। সুখী হওয়ার জন্য তিনি পাঁচটি উপায়ের কথা বলেছিলেন। যেগুলোর নাম দিয়েছিলেন ‘পাঁচ সদ্গুণ’। চীনা ভাষায় গুণ পাঁচটি হলো ই, লি, রেন, ঝি এবং সিন। কনফুসিয়াসের মতে, সুখী এবং অর্থময় জীবনের জন্য এই পাঁচ গুণের প্রতিটিই খুব গুরুত্বপূর্ণ। ‘ই’ হলো সততা এবং ন্যায়পরায়ণতা, ‘লি’ হলো সদাচার ও ভদ্রতা, ‘রেন’ হলো দানশীলতা ও মানবতা, ‘ঝি’ হলো জ্ঞান ও শিক্ষা এবং ‘সিন’ হলো বিশ্বস্ততা ও আনুগত্য।
কনফুসিয়াসের মৃত্যুর পর
জীবদ্দশায় নয়, কনফুসিয়াসের দর্শন ব্যাপকভাবে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর মৃত্যুর পরে। ১৩৬ খ্রিষ্টপূর্ব চীনের রাষ্ট্রীয় নীতিতে কনফুসিয়াসের দর্শন স্থান পায়। কনফুসিয়াসিজম নামে পরিচিত এই ধারা পরবর্তী দুই হাজার বছর টিকে ছিল। কনফুসিয়াস সম্ভবত নিজে কোনো বই লেখেননি। পরবর্তী সময়ে অনুসারীরা তাঁর বাণী সংগ্রহ করে লিপিবদ্ধ করেছে।
কনফুসিয়াসের জন্মের আগের কথা
চীনা ভাষার সবচেয়ে পুরোনো লেখার প্রতিলিপি পাওয়া যায় ষাঁড়ের হাড় বা কচ্ছপের খোলসে (ওরাকল বোন) খোদাই করা অবস্থায়। সেটি শ্যাং রাজত্বকালের (খ্রিষ্টপূর্ব ১৬০০–১০৪৬) বলে জানা গেছে। বিশেষজ্ঞরা শ্যাংদের অস্তিত্বকে ‘মিথ’ ভাবলেও ওই লেখাগুলো কিন্তু উল্টো কথা বলে। এ তো গেল লেখার কথা। চীনের প্রথম দার্শনিক হলেন লাও জু। ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বের দিকে তিনি জীবিত ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তিনি তাওইজম নামের একটি ধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন। এই ধর্মের মূল নীতি ছিল সততা এবং সম্প্রীতি।
কনফুসিয়াসের আবির্ভাবের পর যা হলো
চীনা দার্শনিক মেনসিয়াস (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৭২–২৮৯) কনফুসিয়াসের দর্শনকে আরেক ধাপ এগিয়ে নেন। তিনি জনগণকে একত্র হয়ে অত্যাচারী শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য আহ্বান জানাতেন। যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন (১৭৪৩-১৮২৬) কনফুসিয়াসের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।
কনফুসিয়াস কীভাবে দুনিয়া বদলে দিলেন
কনফুসিয়াসের আমলে শাসকেরা জনগণের সঙ্গে যথেচ্ছ আচরণ করতে পারত। ফলে এটা খুব অভিনব এবং নতুন ভাবনা ছিল যে শাসকেরা জনগণের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে এবং তাদের প্রতি দয়াশীল হবে। কনফুসিয়াসের ভাবনা ভবিষ্যতের পৃথিবীতে সুশাসনের পথ অনেকটাই ত্বরান্বিত করেছে।
সূত্র: হান্ড্রেড ইভেন্ট দ্যাট মেড হিস্ট্রি এবং ব্রিটানিকা ডটকম