কোমলে কঠোরে মেশানো সত্যিকার রানা

২০১৯ সালের ৪ জানুয়ারি প্রথম আলোর শুক্রবারের ক্রোড়পত্র ‘অন্য আলো’তে ছাপা হয়েছিল কাজী আনোয়ার হোসেনের একটি সাক্ষাৎকার। এখানে রইল সেই সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ

কাজী আনোয়ার হোসেন (১৯ জুলাই ১৯৩৬—১৯ জানুয়ারি ২০২২)
ছবি: প্রথম আলো, কোলাজ: একটু থামুন

সেবার প্রয়োজন ফুরাবে না

সুদীর্ঘ ৫৫ বছর ধরে পাঠক মাসুদ রানা পড়েছে এবং মজা পেয়েছে। এখনো সেই প্রথম বই কুয়াশা, ধ্বংস পাহাড়–এর মতোই নতুন বইগুলো যারা সাগ্রহে কিনে পড়ছে, তাদের মধ্যে নিত্যনতুন কিশোর আছে, তাদের স্বপ্নের বাগান ফুলে-ফলে সমৃদ্ধ করে দিচ্ছে সেবা প্রকাশনী; আগামী ৩০ বছরেই তাদের সব আগ্রহ শেষ হয়ে যাবে, এটা আমি মনে করি না। নিজে থাকব না, কিন্তু যাদের গড়েপিটে দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি, আমি জানি, তারা আরও বহুদিন টিকিয়ে রাখবে সেবা ও তার সিরিজগুলোকে। তা ছাড়া, আমার খাতিরে বা আমার মুখ চেয়ে পাঠকেরা এসব বই কিনে পড়ছেন, ব্যাপারটা তা তো নয়, নিশ্চয়ই এসব কাহিনির ভেতর অন্তর্নিহিত বিশেষ কিছু আকর্ষণ ও আবেদন রয়েছে, যেগুলো সমালোচকদের চোখ এড়িয়ে গেছে। তা না হলে যেসব সুসাহিত্যিক এত দিন মাসুদ রানার প্রতি তুচ্ছতাচ্ছিল্য প্রকাশ করে নিজেদের অনেক উঁচুতে তুললেন, এতগুলো বছর চেষ্টা করেও তাঁরা কি পাঠকদের এসব বাজে লেখা থেকে সরিয়ে নিজেদের লেখার প্রতি টানতে পেরেছেন? না। তাঁদের বিচরণক্ষেত্র ভিন্ন, কৈশোর পেরিয়ে তবেই না পরিণত বয়সে পৌঁছাবে মানুষ। আমিই কি কিশোর পাঠকদের চিরকৈশোরে ধরে রাখতে পারছি, ঠেলে দিচ্ছি না তাদের দিকে? ৩০ কেন, আগামী ৬০ বছরেও সেবার প্রয়োজন ফুরাবে বলে মনে করি না।

লিখতে উৎসাহ দিয়েছেন বাবাও

আমার বাবা কাজী মোতাহার হোসেন প্রবন্ধ রচনা করতেন, বোন সন্‌জীদা খাতুন আত্মজীবনীমূলক সরস লেখার পাশাপাশি কঠোর ভাষায় পাঠ্যপুস্তক ধাঁচের বইও লিখেছেন, বড় বোন যোবায়দা মির্যা আত্মজীবনীর মতো করে লিখেছেন সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি। আমার ভাই আর আমি লিখেছি রহস্য-রোমাঞ্চের বই। এ নিয়ে কারও বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়নি আমাদের। বাবা তো রীতিমতো উৎসাহ দিয়েছেন। সন্‌জীদা খাতুনও আমার প্রথম রচনা কুয়াশা ১-এর পাণ্ডুলিপি পড়ে যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছেন।

চিরকিশোর রয়ে গেছি

থ্রিলার আমার ভালো লাগে। সেই কৈশোরে, আজ থেকে ৭৩ বছর আগে, কলকাতা থেকে প্রকাশিত হেমেন্দ্রকুমার রায়ের লেখা ঘটোৎকচ, যকের ধন, আবার যখের ধন, নৃমুণ্ডু শিকারী ইত্যাদি থ্রিলার বই আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলে। তার পরপরই হাতে পেলাম রবিনহুড। লেখকের নাম জানি না, সেসব খেয়াল করার বয়স ছিল না সেটা—বইটি অনেক খুঁজেও হাতে পাইনি আর। অপূর্ব লেগেছিল। রবিনের মৃত্যুতে কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়েছিলাম; তার বীরত্ব, সাহস, নেতৃত্ব, বিপদগ্রস্ত ও ভাগ্যাহতদের প্রতি দুর্বলতা, গরিবদের সাহায্য-সহযোগিতা, নারীর প্রতি সম্মান—এসব গুণের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম।

এই বইগুলো আমাকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে আজও সে মোহের জাল কেটে বেরোতে পারিনি, চিরকিশোর রয়ে গেছি। লঘু বলেন বা বলেন অকিঞ্চিৎকর সাহিত্য; আমি আমার ভালোবাসার জগতে দিব্যি আরামে ও আনন্দে বিচরণ করছি আজীবন।

২০১১ সালে সেবা প্রকাশনী কার্যালয়ে কর্মব্যস্ত কাজী আনোয়ার হোসেন
ছবি: প্রথম আলো

প্রায় সব লেখকের লেখাতেই ভুল থাকে

সম্পাদনার কাজটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করি। কারণ, একটি বই কেবল আনন্দই দিচ্ছে না, পাঠককে নানা ধরনের শিক্ষাও দিচ্ছে। তবে সম্পাদনা যিনি করবেন, তাঁর সে কাজের যোগ্যতা থাকা অপরিহার্য। প্রায় সব লেখকের লেখাতেই ভুল থাকে। বিদেশের মতো আমরাও যদি সুশিক্ষিত, উপযুক্ত সম্পাদক নিয়োগ দিতে পারতাম, তাহলে ভালো হতো। কিন্তু আমাদের বাজার ছোট বলে পারি না। শ্রদ্ধেয় চিত্তরঞ্জন সাহা তাঁর প্রকাশনী মুক্তধারায় এই চেষ্টা করে দেখেছেন, কিন্তু তেমন ভালো ফল পাননি। একজন উপযুক্ত সম্পাদককে যে পরিমাণ সম্মানী দেওয়া উচিত, তার দশ ভাগের এক ভাগও তো আমরা দিতে পারি না।

সিনেমার প্লেব্যাকে গেয়েছি বাংলা ও উর্দু গান

শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চা আমাদের পরিবারের মজ্জাগত। বাবা শিক্ষক ছিলেন, আমার বেশির ভাগ বোনই শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন। সেই সঙ্গে চলেছে গানবাজনার চর্চা। বোনেরা গেয়েছেন রবীন্দ্রসংগীত; আমার বাবা, সেজ কাকা আর ছোট ভাই কাজী মাহবুব হোসেন বাজিয়েছেন সেতার। আমার একটু ভিন্ন পথই পছন্দ। রেডিও-টিভিতে আমি গেয়েছি আধুনিক, নজরুলগীতি ও পল্লিগীতি; সিনেমার প্লেব্যাকে গেয়েছি বাংলা ও উর্দু গান। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৮ সাল—১০টা বছর গান গাইলাম, আর কত?

তা ছাড়া, তত দিনে লেখালেখি ও প্রকাশনা ব্যবসাকে পেশা হিসেবে নিয়ে ফেলেছি—দুটোই পূর্ণাঙ্গ চাকরির মতো। একজীবনে সবকিছু তো আর হয় না।

এই অঞ্চলের নাবালক রোমাঞ্চ সাহিত্যকে একাই সাবালক করে তুলেছিলেন তিনি
ছবি: প্রথম আলো

আমি তো চলেই যাব

সব মিলিয়ে শিল্প-সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ খুব ভালো—এমনটি বলতে পারছি না, দুঃখিত। শুধু থ্রিলার সাহিত্য কেন, এ দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা, নাচ-গান-বাজনা-সিনেমা-ছবি-ভাস্কর্য, অর্থাৎ যা কিছু সুন্দর, সব ধরনের শিল্পসৃষ্টির ধারা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে ক্রমে। কিসের করালগ্রাস গিলে খাচ্ছে আমাদের সৌন্দর্যবোধ, সেটা বাঙালিকে বুঝতে হবে। আমি তো চলেই যাব, যাঁরা এখানে থাকবেন, তাঁদের সতর্ক হওয়ার কিন্তু এখনই সময়।

সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন রওশন জামিলশিবব্রত বর্মন