খালের পানিতে কান ধরে সাতবার ডুব দিয়ে তওবা করলেন জীবনে ভোটে অংশ নেবেন না

গেল ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছে মেহেরপুরের গাংনী পৌরসভা নির্বাচন। পৌরসভাটির ৬ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মোকলেছুর রহমান। নির্বাচনে পরাজিত হলে স্থানীয় একটি খালে ডুব দিয়ে এই প্রার্থী প্রতিজ্ঞা করেন, জীবনে আর কখনো ভোটে দাঁড়াবেন না। কান ধরে তাঁর পানিতে ওঠবস করার ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওতে দেখা গেছে, শীতের বিকেলে কান ধরে ঠান্ডা পানিতে ডুব দিচ্ছেন মোকলেছুর রহমান। এ সময় তিনি বলছেন, ‘আর জীবনে বেঁচে থাকা পর্যন্ত কাউন্সিলর পদে ভোট করব না, করব না, করব না।’ কেন তিনি এ কাজ করলেন, একটু থামুনকে জানালেন সাক্ষাৎকারে।

মোকলেছুর রহমান
সংগৃহীত

প্রশ্ন :

নির্বাচনে দাঁড়ালেনই কেন, এভাবে পানিতে ডুবে প্রতিজ্ঞাই করলেন কেন?

নির্বাচনে আমি নিজের ইচ্ছায় দাঁড়াইনি। এলাকার মানুষ, পাড়াপড়শির কথায় নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। পেশাগত কারণে এলাকার মানুষের কাছে আমি সুপরিচিত। সবাই তখন উৎসাহ দিয়েছিল। আমিও ভাবলাম, আমাদের ওয়ার্ডের মানুষ গাংনী পৌরসভার অন্য ওয়ার্ডগুলোর চেয়ে কম সুবিধা পায়। আমি জয়ী হলে এলাকার উন্নয়ন হবে, গরিব মানুষ সহায়তা পাবে।

প্রশ্ন :

আপনার পেশা কী?

আমি স্থানীয় একটি কেব্‌ল সংযোগদাতা প্রতিষ্ঠানে স্বল্প বেতনে চাকরি করি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাসের বিল তোলাই আমার দায়িত্ব। এ জন্য আত্মীয়স্বজন ছাড়াও এলাকার মানুষের সঙ্গে বাড়তি যোগাযোগ তৈরি হয়েছে।

প্রশ্ন :

সবার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বলেই নির্বাচনে প্রার্থী হলেন?

জি, মানুষের উৎসাহেই দাঁড়িয়েছি। আমার স্ত্রী-সন্তানেরা অবশ্য বাধা দিয়েছিল। সন্তানেরাও তো বড়। মেয়েটা স্থানীয় কলেজে অনার্সে পড়ে। ছেলেটা অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। তাদের তখন বুঝিয়েছি, আমি একজন সৎ মানুষ, এলাকার উন্নয়নে কাজ করতে পারব। তা ছাড়া এলাকার সবাই তো পাশেই আছে।

প্রশ্ন :

তারপর...

ছয় মাস আগের ঘটনা এটা। তারপর তো প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। এলাকাবাসীকে একদিন বাড়িতে দাওয়াত করলাম। তাঁরা খেয়েদেয়ে সেদিনও উৎসাহ দিলেন, উপস্থিত সবাই বললেন, ভোট দেবেন। জমানো টাকা খরচ হতে থাকল। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি।

আমার শিক্ষা হয়ে গেছে। তাই কোনো ভালো লোক আমার কাছে নির্বাচনের জন্য পরামর্শ চাইতে এলে বলব—ভাই, ভোট করার দরকার নাই!
মোকলেছুর রহমান, পরাজিত কাউন্সিলর পদপ্রার্থী, গাংনী পৌরসভা, মেহেরপুর

প্রশ্ন :

কেন রাখেনি?

এটা ভাই আমি বলতে পারব না। কোনো পাপ হয়তো করেছিলাম, সেই পাপের শাস্তি আমি আমার ৪৬ বছরের জীবনে পেলাম।

প্রশ্ন :

কত ভোট পেয়ে আপনি হেরেছেন?

আমিসহ আমাদের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে ৬ জন কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলাম। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আমি ১২৫ ভোট পেয়েছি। বিজয়ী প্রার্থী পেয়েছেন ৩৭৬টি। আমার আত্মীয়স্বজন ভোট দিলেও আমি চার শতাধিক ভোট পেতাম।

প্রশ্ন :

অনেকেই তো হেরেছেন, তাই বলে পানিতে ডুবে তওবা করার সিদ্ধান্ত নিতে হলো!

ভোটের আগেই কিন্তু আমি সিদ্ধান্তটা নিয়েছি। পৌরসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যখন যেতে শুরু করলাম, তখন প্রথম দিন থেকেই মানুষের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ করলাম। এরপর নিজের মতো করে যাচাই করে বুঝলাম, আমি জিততে পারব না। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ভোটের দিন বিকেলে খালে গিয়ে কান ধরে সাতবার ডুব দেব আর তওবা করব জীবনে ভোটে অংশ না নেওয়ার।

প্রশ্ন :

সেটাই শেষ পর্যন্ত করলেন!

হ্যাঁ, ১৬ জানুয়ারি আমাদের পৌরসভার ভোট গ্রহণ হয়। বিকেল চারটার দিকে একটি কেন্দ্র থেকে বের হয়ে দোকানে (এই দোকানে বসেন তিনি) যাই। সেখানে রাখা লুঙ্গি-গামছা নিয়ে পাশের খালের দিকে যাই ডুব দিতে।

প্রশ্ন :

কিন্তু এত দর্শনার্থী নিয়ে গেলেন কেন?

আমি কাউকে নিয়ে যাইনি। দোকান থেকে লুঙ্গি-গামছা নিয়ে যখন বের হই, তখন ছেলেপুলে দেখে ফেলে। কৌতূহলী হয়ে তারা আমার পিছু নেয়। একসময় দেখি, অনেকে চলে এসেছে।

প্রশ্ন :

এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনি ভাইরাল...

উপস্থিত সবার উদ্দেশে আমি কিন্তু বলেছিলাম, ছবি-ভিডিও যেন না করে। তারপরও একজন ভিডিওটা ফেসবুকে ছেড়ে দিয়েছে। এটা ঠিক করেনি...

প্রশ্ন :

কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাইলে আপনার পরামর্শ কী হবে?

আসলে ভোটে দাঁড়ানো নিম্নশ্রেণির একটা কাজ, বুঝলেন। হাত-পা ধরে ভোট চাইতে হয়। আমার শিক্ষা হয়ে গেছে। তাই কোনো ভালো লোক আমার কাছে নির্বাচনের জন্য পরামর্শ চাইতে এলে বলব—ভাই, ভোট করার দরকার নাই!

প্রশ্ন :

অনেক কথা হলো, আপনাকে ধন্যবাদ। সাক্ষাৎকারের সঙ্গে প্রকাশের জন্য আপনার একটা ছবি পেতে পারি?

দুঃখিত ভাই, আমি ছবি দিতে পারব না! আমার টাচ ফোন (স্মার্টফোন) নাই। আমার অনেক দিনের শখ ছিল, একটা টাচ ফোন কেনার, সেটা মনে হয় আর জীবনে হবে না।