গাধা না হাতি, কোনটি সুবিধার?

প্রশ্নটাই আপত্তিকর। দুটিই সওয়ারি নিতে প্রস্তুত এবং নিরীহ প্রকৃতির। প্রতীকের বিবেচনায় অবশ্য দুটি দুই ঘরানার। একটি রাজার বাহন। আর অন্যটি নাসিরুদ্দিন হোজ্জার বাহন হিসেবে বিখ্যাত। আবার ঈশপের গল্পে এ দুই প্রাণীকে পাওয়া যায় দুই ভূমিকায়।

গোটা বিশ্ব এখন অবশ্য এসব হাতি বা গাধার কোনোটি নিয়েই মাতোয়ারা নয়। বিশ্ববাসী আলাপে ব্যস্ত অন্য দুই হাতি-গাধা যুগল নিয়ে। মার্কিন মুলুকের নির্বাচনে এ দুই প্রাণী চার বছর পরপর ফিরে আসে ব্যালটে ব্যালটে। ফিরে না এসে উপায় নেই। আগে লোকে মোগলের হাতে পড়ে খানা খেত। এখন সেই মোগলও নেই, লোকের অনিচ্ছায় খাওয়ার বিলাসও নেই। তবে মার্কিন মুলুক তো আছে। ফলে লোকের খাওয়া জুটুক না জুটুক, হাতি আর গাধা লাল-নীল রং মেখে ঠিকই ব্যালটে এসে ঠাঁই নিতে হচ্ছে।

মশকরাপ্রবণ মানুষ অবশ্য গোটা বিশ্বে রাজত্ব করা দেশটির নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে তামাশায় ব্যস্ত। হাতি প্রতীক দেখে রিপাবলিকান দলকে কেউ ‘মাথামোটা’ বলছে, তো অন্য কেউ ডেমোক্র্যাটদের শুধু ‘গাধা’ বলেই নিচ্ছে এক হাত। গত চার বছর ডোনাল্ড ট্রাম্প জমানার কারণে কেউ যদি হাতিকে এখন মিথ্যাবাদী বলে, তবে প্রতিবাদ করার কোনো সুযোগ নেই। এই মশকরার যেন কোনো শেষ নেই। এই মশকরায় হাতি ও গাধা প্রাণী যুগলের মনের অবস্থা কী, তা জানার অবশ্য কোনো সুযোগ নেই।

দুই দলের শতবছরের পুরোনো এ দুই প্রতীক ও মার্কিন রাজনীতি মিলিয়ে কৌতুকের কি শেষ আছে। ঈশপের গল্পে থাকা গাধার গানের রেফারেন্স টেনে কেউ যদি বলে, গাধা বকে বেশি। তো পাল্টা শুনতে হবে সার্কাসের হাতির লম্বা শুঁড় আর তার গগনবিদারি ডাকের আলাপ। ‘এ কারণেই এ দুটি প্রাণীকে প্রতীক হিসেবে বেছেছে মার্কিন দল দুটি’—এমন কথা ছাড়া তখন আমাদের মতো তৃতীয় পক্ষের আর কী বলার আছে?

তবে এ দুই প্রতীক নিয়ে যত মশকরাই হোক, গাধা ও হাতির মতো নিরীহ দুই প্রাণীকে সামনে রেখে দুই দল যখন গোটা বিশ্বকে নাকানিচুবানি খাওয়ায়, তখন কিন্তু আর তামাশার সুযোগ থাকে না। তখন অবস্থা দেখে মনে হয়, আদতে নিজেদের প্রতীক হিসেবে নয়, নিজেদের করণীয় ঘোষণা করতেই এ দুটি প্রতীক বেছে নিয়েছে দল দুটি। সে আলাপে পরে আসা যাবে।

১৮৭৪ সালে প্রকাশিত টমাস ন্যাস্টের সেই কার্টুন

এ দুই প্রাণীর একটিও কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব নয়। এরপরও তারা এ দুটিকেই প্রতীক হিসেবে বেছে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে গাধার যাত্রাটা শুরু হয়েছে ১৮২৮ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের সময়। জ্যাকসন সে সময় ‘জ্যাকঅ্যাস’ অভিধা পান। আর কার্টুনিস্ট টমাস ন্যাস্ট তাঁর কার্টুনে ডেমোক্র্যাটদের বোঝাতে গাধার প্রতীক ব্যবহার করেন। আর হাতির প্রতীকটি রিপাবলিকানরা পেয়ে যান ১৮৬১ সালেই ‘সিইং দ্য এলিফ্যান্ট’ শব্দবন্ধ থেকে। ‘দ্য এলিফ্যান্ট’ বলতে এখানে যুদ্ধ বোঝানো হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধ চলাকালে সৈনিকদের মধ্যে চালু এই শব্দ এবং এর প্রেক্ষাপট ব্যবহার করে ১৮৭৪ সালে সেই টমাস ন্যাস্টের কার্টুনেই রিপাবলিকানদের প্রতীক হিসেবে ‘হাতি’ ব্যবহার করা হয়। সেই থেকে এখনো এ দুই প্রতীক ব্যবহৃত হচ্ছে।

কথা হলো এত বছর ধরেও এ দুই দল কেন এই প্রতীকেই আটকে আছে? প্রশ্নটি অবান্তর। উল্টো প্রশ্ন হওয়া উচিত, কেন থাকবে না? কারণ, প্রতি চার বছর পর এ দুই প্রতীকের কল্যাণেই যুক্তরাষ্ট্র নামের মোড়ল দেশটি ক্ষমতার ভাগীদারদের নিয়ে গোটা বিশ্ব একটু হালকা রসিকতার সুযোগ পায়। এই রসিকতা দেশটির প্রতি অন্য দেশের নাগরিকদের জমা হওয়া ক্ষোভ একটু প্রশমিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। আর বাকি চার বছর? ওভাল অফিসে বসে সুযোগের চূড়ান্ত সদ্ব্যবহারটি করে জয়ী দল। ডেমোক্র্যাটরা জয়ী হলে গোটা বিশ্বকে ঠান্ডা মাথায় গাধা বানিয়ে কয়েক মাসের তামাশার শোধ তোলে চার বছর ধরে। আর রিপাবলিকানরা জয়ী হলে কী করে, তা তো সবাই জানে। হাতির মতো পিষে দিতে থাকে চারপাশ। ‘সিইং দ্য এলিফ্যান্ট’ শব্দবন্ধের ইজ্জত রেখেছে তারা।

গোটা বিশ্বের জন্য তবে কে ভালো—এ প্রশ্ন তাই অবান্তর। বরং প্রশ্ন করা উচিত, কে কম বিপজ্জনক? অবশ্য দুঃখ এই যে মার্কিনরা ছাড়া এই কম বিপজ্জনক বিকল্প বেছে নেওয়ার কোনো সুযোগ বিশ্বের আর কারও নেই। অবশ্য রাশিয়ার এখনো আছে কি না, তা এখনো হলফ করে বলা সম্ভব নয়।