জ্যামাইকানরা দৌড়ে এত এগিয়ে কেন?

মেয়েদের ২০০ মিটার স্প্রিন্ট জিতলেন জ্যামাইকার অ্যালেইন থম্পসন–হেরা
ছবি: রয়টার্স

পত্রিকার পাতায় আজ বড় করে এলেইন থম্পসন-হেরার ছবি ছাপা হয়েছে। নারীদের ২০০ মিটার স্প্রিন্টে গতকাল অলিম্পিকে সোনা জিতেছেন এই জ্যামাইকান দৌড়বিদ।

যাঁরা অলিম্পিকে চোখ রেখেছেন, তাঁরা তো জানেনই। আর যাঁদের কাছে নামটা চেনা চেনা লাগছে, তাঁদের জন্য বলি, গত ৩১ জুলাই ১০০ মিটার স্প্রিন্টেও চ্যাম্পিয়ন তিনি। অর্থাৎ অলিম্পিকের এক আসরে দ্বিমুকুট জিতলেন। তাও পরপর দুবার, রিওতেও গড়েছেন একই কীর্তি।

জ্যামাইকার তিন কৃতী স্প্রিন্টার শেলি-অ্যান ফ্রেজার-প্রাইস, এলেইন থম্পসন-হেরা ও শেরিকা জ্যাকসন
ছবি: রয়টার্স

মজার ব্যাপার হলো, টোকিও অলিম্পিকে নারীদের ১০০ মিটার স্প্রিন্টে সোনা, রুপা ও ব্রোঞ্জ—তিন পদকই উঠেছে জ্যামাইকানদের ঘরে। এলেইনের সঙ্গে ছিলেন শেলি-অ্যান ফ্রেজার-প্রাইস ও শেরিকা জ্যাকসন।

পুরুষ স্প্রিন্টারদের উদাহরণ যদি চান, তবে উসাইন বোল্ট সবচেয়ে জ্বলজ্বলে তারা। ১০০ মিটার স্প্রিন্টে সেই যে রেকর্ড গড়েছেন ২০০৯ সালে, ১৩ বছরে সে রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারেননি। আবার দ্রুততম সময়ে ১০০ মিটার ট্র্যাক পেরোনোর রেকর্ডে শীর্ষ দশের পাঁচজনই কিন্তু জ্যামাইকার।

জ্যামাইকান স্প্রিন্ট কিংবদন্তি উসাইন বোল্ট
ছবি: এএফপি

এত উদাহরণ যখন সামনে, দৌড়ে জ্যামাইকানরা বারবার চ্যাম্পিয়ন হচ্ছেন কেন, সে প্রশ্ন জাগাটা কি অস্বাভাবিক? মনে হয় না। কারণ, বিজ্ঞানীদের মনেও একই প্রশ্ন ছিল। এরপর জিন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি হয়েছে। জ্যামাইকার মাটি খুঁড়তেও বাকি রাখেননি তাঁরা। দ্য গার্ডিয়ানসহ বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদনও হয়েছে বেশ আগেই। এবার আমরাও সে প্রশ্নের খানিকটা উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি চলুন।

ব্যাপারটা কি জেনেটিক?

শুরুতেই ব্যাপারটা জেনেটিক কি না, তা জানার চেষ্টা করা যেতে পারে। আর সেটার শুরু হোক অ্যানজিওটেনিজম-কনভার্টিং এনজাইম বা এসিই জিন দিয়ে।

দ্য গার্ডিয়ানে বলা হয়েছে, শরীরে যদি এই জিনের নির্দিষ্ট একটি ভেরিয়েন্ট (‘ডি অ্যালিয়েল’ হিসেবে পরিচিত) থাকে, তবে গড় আকারের চেয়ে আপনার হৃদ্‌যন্ত্র বড় হতে পারে। এতে গড় মানুষের চেয়ে আপনার শরীরের পেশিগুলোয় দ্রুত উচ্চ অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্তের সরবরাহ সম্ভব হয়। প্রশিক্ষণেও এতে সুফল পাওয়া যায়।

ইউরোপীয় এবং জাপানিদের চেয়ে পশ্চিম আফ্রিকান বংশোদ্ভূতদের মধ্যে জিনের এই ভেরিয়েন্ট বেশি দেখা যায়। আর পশ্চিম আফ্রিকার তুলনায় জ্যামাইকার লোকজনের মধ্যে সেটির উপস্থিতি বেশি।

ক্রিকেটের মহাতারকা ক্রিস গেইলও কিন্তু জ্যামাইকার সন্তান
ছবি: রয়টার্স

এই জিন থাকলেই যে কেউ দৌড়ে চ্যাম্পিয়ন হবেন, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ, জ্যামাইকান ক্রীড়াবিদদের অর্জন তাঁদের মেধা আর পরিশ্রমের ফসল, সব কৃতিত্ব তাঁদের পূর্বপুরুষদের নয়। তবে পূর্বপুরুষের জিন থেকে তাঁরা কিছুটা সুবিধা পাচ্ছেন কি না, সে প্রশ্ন করার সুযোগ তো আছেই। যেমন এসিই জিনের ডি অ্যালিয়েল ভেরিয়েন্টের সুফল কেউ কেউ পাচ্ছেন। আর সেই সুফল আরও বেড়ে যাবে, যদি একই সঙ্গে শরীরে এসিটিএন৩ জিন থাকে।

এসিটিএন৩ জিনটি ‘আলফা-অ্যাসিটিনিন-৩’ নামের প্রোটিন তৈরির জন্য নির্দেশনা তৈরি করে, যা বারবার পেশিকে সংকুচিত করতে সাহায্য করে। এসিই জিনের মতো এটারও বিভিন্ন ধরন আছে। স্প্রিন্টারদের জন্য প্রয়োজনীয় ধরনটি হলো ‘৫৭৭আরআর’।

যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্রীড়াবিদদের কেবল ৭০ শতাংশের মধ্যে এই ভেরিয়েন্ট পাওয়া যায়। আর ক্রীড়াবিদ হোক বা না হোক, ৭৫ শতাংশ জ্যামাইকানের মধ্যে ৫৭৭আরআর ভেরিয়েন্টের এসিটিএন৩ জিন আছে। দৌড়ে জ্যামাইকানদের এগিয়ে যাওয়ার সেটাও একটা কারণ হতে পারে।

আটবার অলিম্পিক পদকজয়ী আরেক জ্যামাইকান তারকা ভেরোনিকা ক্যাম্পবেল ব্রাউন
ছবি: উইকিপিডিয়া

দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউনিভার্সিটি অব দ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের গবেষক রেচ্যাল আরভিং এবং ভিলমা চার্লটন দেখলেন, উসাইন বোল্ট, ভেরোনিকা ক্যাম্পবেল ব্রাউনসহ অনেক ক্রীড়াবিদ দ্বীপরাষ্ট্রটির অ্যালুমিনিয়াম আকরিকসমৃদ্ধ অঞ্চল থেকে এসেছেন।

অনেক অলিম্পিয়ানের মা-বাবাও ওই অঞ্চলে জন্মেছেন, বেড়ে উঠেছেন। গর্ভকালীন প্রথম তিন মাসে এসিটিএন৩ জিন প্রভাব ফেলতে পারে। ওই সময় ভ্রুণের বেশ কিছু পেশির তন্তু গঠিত হয়।

আরভিং ও চার্লটনের ধারণা, অন্তঃসত্ত্বা মায়ের খাবারে অ্যালুমিনিয়াম ওই জিনের কার্যকারিতা বাড়ায়। উসাইন বোল্ট জ্যামাইকার যে অঞ্চল থেকে এসেছেন, সেখানকার মাটি বক্সাইটসমৃদ্ধ। ফলে ওই মাটিতে উৎপন্ন খাদ্যশস্যে প্রাকৃতিকভাবেই উচ্চপরিমাণে অ্যালুমিনিয়াম থাকে। হয়তো সেটাও জ্যামাইকান দৌড়বিদদের জন্য খানিকটা হলেও সুফল বয়ে আনে।

পরম্পরাও একটি কারণ

বেইজিং অলিম্পিকে উসাইন বোল্টের সঙ্গে জ্যামাইকার আরও তিন স্প্রিন্টার
ছবি: রয়টার্স

গুগল ঘাঁটলে এ বিষয়ে অনেক প্রতিবেদন মেলে। অনেক তথ্যচিত্রও আছে। সেগুলোয় বলা হয়েছে, উপসংহারে পৌঁছানোর মতো পর্যাপ্ত তথ্য এখনো আমাদের হাতে নেই। আবার ব্যাপারটি কেবল জেনেটিক নয় বলে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের উপসম্পাদকীয়তে লিখেছেন জ্যামাইকান-মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী অরলান্দো প্যাটারসন। তাঁর মতে, এর পেছনে আছে জ্যামাইকার স্কুলগুলোর ‘চ্যাম্পস’ প্রতিযোগিতা। এর পোশাকি নাম ইন্টার সেকেন্ডারি স্কুলস স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন বয়েজ অ্যান্ড গার্লস অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপ।

দেশজুড়ে আয়োজিত এই প্রতিযোগিতায় স্কুলশিক্ষার্থীরা অংশ নেন। পাইপলাইনে পর্যাপ্ত ভালো স্প্রিন্টার তৈরির পেছনে দেশব্যাপী এই ‘ইকোসিস্টেমের’ ভূমিকাও অস্বীকার করার উপায় নেই।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, এনপিআর ডটওআরজি ও নিউইয়র্ক টাইমস

আরও পড়ুন